জনপ্রিয় হচ্ছে প্লাস্টিকের দরজা

আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে কাঠের বিকল্প হিসেবে প্লাস্টিকের দরজা ব্যবহার হয়
আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে কাঠের বিকল্প হিসেবে প্লাস্টিকের দরজা ব্যবহার হয়

ভবন বা গৃহের নিরাপত্তা ও যাতায়াত সুবিধার্থে দরজার ব্যবহার বেশ পুরোনো। একসময় কাঠের তৈরি দরজার চাহিদাই ছিল একচেটিয়া। তবে দাম বেশি হওয়ায় এখন অনেকেই আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে কাঠের বিকল্প হিসেবে প্লাস্টিকের দরজা (আনপ্লাস্টিসাইজড পলিভিনাইল ক্লোরাইড—ইউপিভিসি) ব্যবহার করছেন।
আবার বছর দশেক আগেও দেশে প্লাস্টিকের দরজার বাজার ছিল পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। কিন্তু গত পাঁচ-ছয় বছরে চিত্রটি পাল্টে গেছে। এ দরজার ৯০ শতাংশই এখন দেশে তৈরি হয়। বাংলাদেশ প্লাস্টিকদ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশন (বিপিজিএমইএ) এবং আবাসন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন রিহ্যাবের সঙ্গে আলাপ করে এমন তথ্যই মিলেছে।
এই খাত-সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন পাঁচটি প্রতিষ্ঠান বড় পরিসরে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তিতে প্লাস্টিকের দরজা তৈরি করছে। এর মধ্যে আছে প্রাণ-আরএফএল, পারটেক্স, ন্যাশনাল পলিমার, ইউনাইটেড ডোরস ও স্বপন ডোরস। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান শিগগিরই এমন দরজা তৈরি শুরু করার অপেক্ষায় আছে। পাশাপাশি নিজস্ব যন্ত্রপাতি দিয়ে ছোট আকারের আরও ২৫টির বেশি প্রতিষ্ঠান প্লাস্টিকের দরজা তৈরি করছে। এর বাইরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আমদানি করা প্লাস্টিকের দরজা বিক্রি করে থাকে।
রিহ্যাবের সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাশ্রয়ী মূল্য, প্রতিস্থাপন সুবিধা এবং যুগের চাহিদা মিটিয়ে নিত্যনতুন নকশার কারণে প্লাস্টিকের দরজা ব্যবহারে আবাসন খাতের ব্যবসায়ী ও গ্রাহক সবাই আগ্রহী হয়ে উঠছেন। আমাদের চলমান প্রকল্পগুলোর ৮০ ভাগ ক্ষেত্রেই এই দরজা ব্যবহৃত হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে এটি আরও বাড়বে।’
প্লাস্টিক খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতি মাসে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর তৈরি এক লাখের বেশি প্লাস্টিকের দরজা বিক্রি হয়, যার বাজারমূল্য প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ কোটি টাকা। আমদানি হওয়া দরজার বিক্রি মিলে মাসে তা ৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। সে হিসাবে বছরে কমপক্ষে ৬০০ কোটি টাকার প্লাস্টিকের দরজা বিক্রি হয়। এই বাজার প্রতিবছর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে।
ন্যাশনাল পলিমার প্লাস্টিকের দরজা (‘এনপলি’ ব্র্যান্ড) বানানো শুরু করে ২০১৩ সালে। দেড় বছরের মধ্যেই এই বাজারের বড় একটি অংশ দখল করে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এই দরজা বিক্রি হয় দুই হাজার ২০০ টাকা থেকে চার হাজার ৮০০ টাকায়।
ন্যাশনাল পলিমারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াদ মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সম্ভাবনাময় হওয়ায় প্লাস্টিকের দরজার ওপর আমরা এখন বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছি। মান ভালো হওয়ায় ক্রেতাদের কাছেও খুব ভালো সাড়া পাচ্ছি। উৎপাদন ক্ষমতা দিয়ে আমরা বাজার চাহিদার সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পূরণ করতে পারছি। চাহিদা মেটাতে তাই এ বছর শুরু করতে যাচ্ছি আরও একটি কারখানার উৎপাদন।’ তিনি জানান, দেশব্যাপী চার হাজার ২০০ পরিবেশকের মাধ্যমে তাঁরা দরজা বিক্রি করছেন।
২০০৭ সালে যাত্রা শুরু করে প্লাস্টিকের দরজার বাজারে এখন শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল। প্রতিষ্ঠানটি আরএফএল ব্র্যান্ডের প্লাস্টিকের দরজা বাজারজাত করে থাকে। কসমিক, পপুলার, গোল্ড, সলিড, প্লাটিনাম, গ্লাস—মূলত ছয় ধরনের বিভিন্ন নকশা, রং ও আকারের প্লাস্টিকের দরজা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। খুচরা পর্যায়ে দুই হাজার ২০০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ সাত হাজার ৭০০ টাকায় এসব দরজা কিনতে পাওয়া যায়।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘খুব অল্প সময়েই আমাদের প্লাস্টিকের দরজা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিক্রির হিসাবে বাজারের প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ এখন আমাদের দখলে। দিন দিন তা আরও বাড়ছে। আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে প্লাস্টিকের দরজার শিল্পকে আমরা উৎপাদননির্ভর ও স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি শিল্পে পরিণত করেছি।’
এ খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চার-পাঁচ বছর আগেও প্লাস্টিক দরজার চাহিদার ৫০ শতাংশই মিটত আমদানি হওয়া দরজায়। ১০ বছর আগে পুরো বাজারই ছিল আমদানিনির্ভর। আর এখন দেশীয় উৎপাদকেরাই এই বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এমনকি বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে প্লাস্টিকের দরজা স্বল্প পরিসরে রপ্তানি করছে।
তবে এ খাতে উল্টো চিত্রও আছে। ব্যবসায়িকভাবে টিকতে না পেরে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্লাস্টিকের দরজা বানানো বন্ধ করে দিয়েছে। এমনই একটি প্রতিষ্ঠান তালুকদার প্লাস্টিক। বছর তিনেক আগে প্রতিষ্ঠানটি বড় ধরনের বিনিয়োগ করে প্লাস্টিকের দরজার ব্যবসা শুরু করলেও বর্তমানে তাদের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। আবার প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক ছোটখাটো অনেক কারখানাই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, তাঁদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বিদ্যুৎ। প্লাস্টিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে একবার উৎপাদন বন্ধ হলে আবার তা চালু করতে যেমন সময় নষ্ট হয়, তেমনি উৎপাদন খরচও বেড়ে যায়। এভাবে দিনে চার থেকে পাঁচবার বিদ্যুৎ বিভ্রাটের শিকার হলে আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে কম পুঁজির ব্যবসায়ীদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে ন্যাশনাল পলিমারের রিয়াদ মাহমুদ বলেন, বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বিকল্প উপায়ে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে কাজ চালিয়ে নিতে পারলেও ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো সেটি করতে পারছে না। অনেকেই তাই ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে। সরকার নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে পারলে প্রতিবছরই এই খাতের প্রবৃদ্ধি ৩০ শতাংশ করে বাড়ানো সম্ভব।
১ লাখের বেশি দরজা বিক্রি হয় প্রতি মাসে
৯০% চাহিদা মিটছে এখন দেশীয় দরজায়
৬০০ কোটি টাকা লেনদেন হয় বছরে