ঝালকাঠির খালে-বিলে পেয়ারার ভাসমান হাট জমে উঠেছে

ঝালকাঠি সদর উপজেলার কীর্তিপাশা ইউনিয়ন ও নবগ্রাম ইউনিয়নে ভীমরুলি বিলসহ বিভিন্ন খালে মৌসুমি ফল পেয়ারার ভাসমান হাট এখন বেশ জমজমাট। দেশের বিভিন্ন জায়গার ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলে আসা পর্যটকদের অনেকেই এ হাট দেখতে আসেন।
বর্তমানে স্থানীয় স্বরূপকাঠি জাতের প্রতি মণ পেয়ারা ৩০০ টাকা পাইকারি দামে (কেজি সাড়ে ৭ টাকা) বিক্রি হচ্ছে। তবে থাই জাতের পেয়ারা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায় (মণ ২ হাজার ৪০০ টাকা)।
ঝালকাঠি কৃষি বিভাগ, পেয়ারাচাষি ও বাগানমালিকদের সূত্রে জানা যায়, এ বছর সদর উপজেলার ২১টি গ্রামে ১ হাজার ৮৫০ একর জমিতে পেয়ারার বাগান রয়েছে। এর মধ্যে কীর্তিপাশা ইউনিয়নের ১০টি গ্রাম কীর্তিপাশা, ভীমরুলি, মীরাকাঠি, ভৈরমপুর, ডুমুরিয়া, খেজুরা, খোদ্দবরাহর, বেশাইন খান, শংকর ধবল, বেউখান ও স্থানসিংহপুর এবং নবগ্রাম ইউনিয়নের নবগ্রাম, হিমানন্দকাঠি, দাড়িয়াপুর, সওরাকাঠি ও কঙ্গারামচন্দ্রপুর—এই ৫টি গ্রামে সবচেয়ে বেশি পেয়ারা উৎপাদন হয়।
ভীমরুলি বিলকে ঘিরে পেয়ারা বাগানের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া আষাঢ় থেকে শ্রাবণ পর্যন্ত তিন মাস ভাসমান নৌকায় বসে পেয়ারার হাট। বাগানমালিক ও চাষি এবং পাইকার ও খুচরা বিক্রেতারা নৌকায় পেয়ারার কেনাবেচা করে থাকেন।
এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, এখন থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে ভীমরুলি বিলের আশপাশে পেয়ারার আবাদ শুরু হয়। এই জাতটি আনা হয়েছিল ভারতের তীর্থস্থান গয়া থেকে। পরে এটি স্বরূপকাঠি জাত নামে পরিচিতি পায়। বংশপরম্পরায় এখানকার মানুষ পেয়ারার আবাদ করে আসছেন। সাধারণত মাঘ-ফাল্গুন মাসে পেয়ারা গাছে ফুল আসে। আর ফল পাকা শুরু হয় আষাঢ় মাসে।
ভাসমান হাটগুলোর মধ্যে কীর্তিপাশা ইউনিয়নের ভীমরুলি গ্রামের ভীমরুলি বিলে গড়ে ওঠা ভাসমান হাটটি সবচেয়ে বড়। অন্য হাটগুলো পেয়ারা বাগানের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া খালের ওপর। সরবরাহ বেশি হওয়ায় এক-দেড় সপ্তাহ আগে প্রতি মণ পেয়ারার পাইকারি দাম ৫০-১০০ টাকায় নেমে আসে। মৌসুম শেষ হয়ে আসায় এখন তা ৩০০ টাকায় উঠেছে।
পেয়ারা কিনে ফেরার পথে স্থানীয় বখাটেরা চাঁদা দাবি করে এবং পুলিশও মাদক আছে বলে তল্লাশি চালিয়ে হয়রানি করে বলে পাইকারেরা অভিযোগ করেন। এতে পেয়ারার ঔজ্জ্বল্য নষ্ট হয় বলে তাঁরা জানান।
এদিকে আমড়া, লেবু ও থাই পেয়ারার আবাদ তুলনামূলক লাভজনক হওয়ায় অনেকেই এখন স্বরূপকাঠি জাতের পেয়ারার চাষ ছেড়ে দিচ্ছেন বলে জানান।
ভীমরুলি গ্রামের শংকর হালদার জানান, তিনি ১০ বিঘা পেয়ারা বাগান কেটে আমড়াগাছ লাগিয়েছেন। কারণ এক বিঘা পেয়ারা বাগানের পেয়ারা ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। অন্যদিকে বিঘাপ্রতি আমড়া বাগান বিক্রি হয় ১ থেকে ২ লাখ টাকা।
একই গ্রামের সবুজ হালদারও জানান, তিনি আগে ৩ একর জমিতে পেয়ারার আবাদ করতেন। ইতিমধ্যে ১ একর জমির পেয়ারা বাগান কেটে আমড়ার চাষ শুরু করেছেন।
নবগ্রামের কাপড়কাঠি গ্রামের বাগানমালিক আইনজীবী শাহালম মল্লিক বলেন, ‘আমি ১০ বিঘা জমির পেয়ারা বাগান কেটে আমড়াগাছ রোপণ করেছি।’
ঝালকাঠি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শেখ আবু বকর সিদ্দিক সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, চাষিরা যে আবাদে লাভ বেশি পাবেন, সেদিকেই আগ্রহী হবেন। যখন দেশি পেয়ারা প্রতি কেজি ৫-১০ টাকায় বিক্রি হয়, তখন আমড়া বিক্রি হয় ৫০ টাকায়। থাই পেয়ারাও বেশি লাভজনক। সে জন্য অনেকেই স্বরূপকাঠি জাতের পেয়ারা ছেড়ে দিচ্ছেন।
পেয়ারার ভাসমান বাজার দেখতে প্রচুর পর্যটকও আসেন। বরিশাল মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী অদিতি সারনিনা ও আয়শা ইসলাম এবং ঢাকায় কৃষি তথ্য সার্ভিসে চাকুরে বাদল সরকার জানান, তাঁরা সুযোগ পেলে এখানে আসেন।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে পর্যটন করপোরেশন এক চিঠিতে জানিয়েছে যে এখানকার পেয়ারা বাগানগুলোকে সরকার পর্যটন এলাকা ঘোষণা করেছে। সে অনুযায়ী অবকাঠামো নির্মাণসহ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও হাতে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসন প্রতিবছরের মতো এবারও ভীমরুলি গ্রামের ভাসমান হাটে পেয়ারা উৎসবের আয়োজন করতে যাচ্ছে।