ঢেউটিন এখন দেশজ পণ্য

ঢেউটিনের বাজারে এখন দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোরই রাজত্ব। শহর কিংবা গ্রাম—সবখানেই ঘরবাড়ি বানানোর এই জনপ্রিয় উপকরণটি উৎপাদনের জন্য কয়েকজন উদ্যোক্তা অনেকটা নিজস্ব প্রচেষ্টায় ভারী শিল্পকারখানা গড়ে তুলেছেন। বছরের পর বছর জোগান দিয়ে যাচ্ছেন উন্নত মানসম্পন্ন ঢেউটিন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, একসময়কার আমদানিনির্ভর এই পণ্যটি এখন দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছে প্রস্তুতকারক কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। তবে গ্যাস-বিদ্যুতের অভাব ও অসাধু কিছু ব্যবসায়ীর কর্মকাণ্ডের কারণে পুরো সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানগুলো।
বাংলাদেশ সিআর কয়েল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া তথ্যমতে, দেশে এইচআর বা হট রোলড কয়েল থেকে প্রথমে কোল্ড রোলড কয়েল এবং তারপর গ্যালভানাইজড কারগোটেড আয়রন শিট কিংবা ঢেউটিন উৎপাদন করে ১০টি প্রতিষ্ঠান।
এগুলো হচ্ছে: আবুল খায়ের গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠান (গরু মার্কা), আর এম কয়েল মিলস, কেডিএস গ্রুপ (কেওয়াই মুরগি মার্কা), পিএইচপি গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠান (অ্যারাবিয়ান হর্স), কর্ণফুলী স্টিল মিলস, এস আলম এবং অ্যাপোলো ইস্পাত (অ্যাপোলো রানী মার্কা)।
অ্যাসোসিয়েশন জানায়, প্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে আট লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন। তবে বর্তমানে উৎপাদন করছে পাঁচ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টনের মতো। এর মধ্যে প্রায় দুই লাখ মেট্রিক টন উগান্ডা, মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর, কলোম্বিয়া, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যভুক্ত এসব প্রতিষ্ঠান ছাড়াও চট্টগ্রাম ও ঢাকায় প্রায় ৩০টির মতো প্রতিষ্ঠান ঢেউটিন উৎপাদন করে। এসব প্রতিষ্ঠান মূলত বিদেশ থেকে সিআর বা জিপি কয়েল আমদানি করে শুধু ঢেউ করে বাজারে করে। এ ছাড়া প্রচলিত ঢেউটিনের পাশাপাশি দেশে রঙিন বা কালার কোডেট ঢেউটিন জনপ্রিয় হচ্ছে। জালালাবাদ স্টিল, আবুল খায়ের গ্রুপ, এস আলম গ্রুপের গ্যালকো স্টিল ও বিল্ড ট্রেড এ ধরনের ঢেউটিন উৎপাদন করে আসছে।
একাধিক উদ্যোক্তা জানান, স্বাধীনতার পর কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ঢেউটিন আমদানি করে দেশের বাজারে বিক্রি করত। আশির দশকের শুরুর দিকে ইলিয়াস ব্রাদার্স (হাতি মার্কা), আসিফ স্টিল (সোয়ান ব্র্যান্ড) ও এনজিএস গ্রুপ (লাড্ডু মার্কা) সিআর শিট আমদানি করে জিংকের প্রলেপ বা গ্যালভানাইজিং করে বাজারে ছাড়ে। পরে পিএইচপি, অ্যাপোলো, এস আলম গ্রুপসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এইচআর কয়েল থেকে ঢেউটিন উৎপাদন করতে শিল্পকারখানা স্থাপন করে।
আরমিট গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সাংসদ সাইফুজ্জামান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বাধীনতার আগে থেকেই আমার বাবা (আখতারুজ্জামান চৌধুরী) অন্যান্য ব্যবসার পাশাপাশি ঢেউটিন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হন। শুরুতে আমদানি করে তা স্থানীয়ভাবে বাজারজাত করা হতো। এরপর আশির দশকে নিজেরাই কারখানা প্রতিষ্ঠা করে সোয়ান ব্র্যান্ড নামে ঢেউটিন উৎপাদন শুরু করেন। এ সময় আমাদের পাশাপাশি ইলিয়াস ব্রাদার্স ও এনজিএস গ্রুপও ঢেউটিন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল।’
সাইফুজ্জামান চৌধুরী জানান, বাংলাদেশে ঢেউটিন ব্যবসায় তাঁদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান অগ্রপথিক হলেও এখন সেই ব্যবসাটি আর নেই। ৯০ দশকে ঢেউটিন ব্যবসা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন।
জানা গেছে, ১৯৮৭ সালে তেজগাঁওয়ে অ্যাপোলো ইস্পাত ঢেউটিন উৎপাদন শুরু করে। অ্যাপোলো রানী মার্কা নামে ঢেউটিন বাজারজাত শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৯৭ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে উন্নত প্রযুক্তির কনটিনিয়াস গ্যালভানাইজিং লাইন বা সিজিএল মিল স্থাপন করে। দুই বছর আরেকটি ইউনিট চালু করে অ্যাপোলো। ২০০৫ সালে উৎপাদন খরচ হ্রাস করতে আধুনিক সিআর মিল স্থাপন করে। এতে ঢেউটিনের মূল কাঁচামাল সিআর কয়েলের পরিবর্তে এইচআর কয়েল আমদানি শুরু হয়।
বর্তমানে অ্যাপোলো পরিবেশবান্ধব নফ প্রযুক্তির পরের প্রযুক্তি জার্মানির আরটিএফ নফ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে বছরে ৬০ হাজার মেট্রিক টন ঢেউটিন উৎপাদন করে।
এসব তথ্য দিয়ে অ্যাপোলোর উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুর রহমান জানান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান ও তাইওয়ান থেকে কাঁচামাল এইচআর কয়েল আমদানি করা হয়। তারপর সেটি দিয়ে পাতলা সিআর কয়েল প্রস্তুত করা হয়। পরে জিংকের সঠিক কোটিং করে ঢেউটিন প্রস্তুত করা হয়।
আবদুর রহমান বলেন, বর্তমানে ঢেউটিনের পাশাপাশি সিআর কয়েল দিয়ে ফ্যানের পাখা, পাইপ, বক্স, গাড়ির বডি, ফ্রিজের বডি ইত্যাদি তৈরি হয়। এ কারণে শিল্পটির সম্ভাবনা অনেক। তবে দেশেই এইচআর কয়েল উৎপাদন হলে ঢেউটিনকে আরও সাশ্রয়ী করা সম্ভব। অবশ্য এ জন্য অনেক বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন।
আবদুর রহমান আরও বলেন, ‘একেকটি এইচআর কয়েলের ওজন ১৮ থেকে ২০ টন। কিন্তু জাহাজ থেকে আমাদের সরাসরি তা ট্রাকে করে নিয়ে আসতে হয়। কোনো কারণে ব্যর্থ হলে প্রতিদিন প্রতি টনে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা জরিমানা গুনতে হয়। সে কারণে সব সময় আমাদের তটস্থ থাকতে হয়। এটি বৈষম্যমূলক। তাই নিয়মটি প্রত্যাহার করা উচিত।’
এস আলম গ্রুপ ১৯৯৫ ঢেউটিন উৎপাদন শুরু করে। বর্তমানে বছরে দুই লাখ মেট্রিক টন ঢেউটিন উৎপাদন করছে প্রতিষ্ঠানটি।
এস আলম গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুস সামাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমানে সেকেন্ডারি পণ্যের মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে কিছু প্রতিষ্ঠান মূলত প্রস্তুতকৃত ঢেউটিন আমদানি করে। আর এই আমদানি করা পণ্য মূল্য আমাদের কাঁচামালের দামের সমান হওয়ায় প্রতিযোগিতায় পড়তে হচ্ছে। এর ফলে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’
আবদুস সামাদ আরও বলেন, ‘এই অশুভ প্রবণতার বন্ধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছি। তারই অংশ হিসেবে কিছুটা সক্রিয় হওয়ায় এই মিথ্যা ঘোষণায় আমদানির পরিমাণ কমেছে। তবে পুরোপুরি বন্ধ না হওয়ায় আমাদের বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’ তিনি জানান, গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকটের কারণে সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানগুলো।
ঢেউটিন উৎপাদন পদ্ধতি
ঢেউটিন তৈরির প্রধান কাঁচামাল এইচআর কয়েল (পুরুত্ব ২ মিলিমিটার)
পিকলিং প্ল্যান্টে নানা রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে এইচআর কয়েল ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়
এইচআর কয়েলকে প্রচণ্ড চাপে বেলনার মধ্য দিয়ে চালনা করে সিআর কয়েলে রূপান্তর করা হয়
কনটিনিউয়াস গ্যালভানাইজিং প্ল্যান্টে সিআর কয়েলকে জিংকের প্রলেপ দিয়ে পিস আকারে বের করা হচ্ছে
উৎপাদনের সবশেষ ধাপে যন্ত্রের সাহায্যে ঢেউ করে আনা হচ্ছে টিন