তিনটি উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা গেলে অনেকের আবাসন হবে

হোসেন খালেদ

আনোয়ার গ্রুপের আবাসন ও অটোমোবাইল ডিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসেন খালেদ। তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে তাঁদের প্রতিষ্ঠান আনোয়ার ল্যান্ডমার্কের পাশাপাশি দেশের আবাসন খাত নিয়ে কথা বলেছেন।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনার বাবা প্রয়াত আনোয়ার হোসেন (আনোয়ার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান) কাপড় থেকে শুরু করে নানা ধরনের ব্যবসা করেছেন। আবাসন ব্যবসায় আসার পেছনের গল্পটা কী?

হোসেন খালেদ: অনেক আগেই বাবা বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবসা শুরু করেন। ষাটের দশকেই তিনি আবাসন ব্যবসায় নামেন। প্রচুর বাসাবাড়ি ও জমি কিনতেন। তারপর সেগুলো সংস্কার করে আবার বিক্রি করতেন। পরবর্তী সময় টেক্সটাইলের পাশাপাশি নির্মাণকাজের ব্যবসায় জড়িয়ে যান। তিনি ঠিকাদার হিসেবে কাজ নিয়ে সাবকন্ট্রাটিংয়ের মাধ্যমে সেই কাজ করাতেন। বেশ কিছু নির্মাণকাজ নিজেও করেন। আশির দশকে রড উৎপাদন শুরু করেন। ১৯৯৭-৯৮ সালে আসে সিমেন্ট। আনোয়ার গ্রুপের সব কারখানার নির্মাণকাজ আমরা নিজেরাই করেছি। সেই ধারাবাহিকতায় আবাসন ব্যবসায় যুক্ত হই আমরা। বাবা সব সময়ই দেশের মুষ্টিমেয় জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করতে বলতেন। ইতিমধ্যে আমরা আবাসন ব্যবসায় সফলতার সঙ্গে দুই দশক পার করেছি।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আনোয়ার ল্যান্ডমার্ক কোন ধরনের গ্রাহকের জন্য আবাসন প্রকল্প করে?

হোসেন খালেদ: আমরা খুবই কনজারভেটিভ (রক্ষণশীল) কোম্পানি। অনেক বেশি প্রকল্প নয়, সীমিতসংখ্যক কিন্তু দৃষ্টিনন্দন ও মানসম্পন্ন প্রকল্প নির্মাণ করাই আমাদের লক্ষ্য। আমাদের প্রথম প্রকল্প ছিল পুরান ঢাকার নবাবপুরে। ফলে বুঝতেই পারছেন, আমরা শুধু সমাজের উচ্চবিত্ত নয়, সাধারণ মানুষের জন্যও প্রকল্প করছি। শ্যামলী, মিরপুর, ধানমন্ডি, জিগাতলা, বসুন্ধরা, উত্তরা, গুলশান, বারিধারার মতো এলাকায় আমাদের আবাসন প্রকল্প রয়েছে। আমরা ঢাকার সব ধরনের ক্রেতার কাছেই পৌঁছাতে পারছি।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: রাজধানীর আবাসন প্রকল্পে ধীরে হলেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। ইদানীংকালে অনেক আবাসন প্রতিষ্ঠানই ভবনের নকশায় সবুজায়নকে গুরুত্ব দিচ্ছে। আপনারা আবাসন প্রকল্প করার ক্ষেত্রে কোন বিষয়ের প্রতি বেশি জোর দিচ্ছেন?

হোসেন খালেদ: রাজউকের বিল্ডিং কোড সবাইকেই মেনে চলতে হয়। তারপরও আবাসন কোম্পানিগুলোর নিজস্ব কিছু ভিশন থাকে। আমরা সবুজায়নকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকি। ঢাকার বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হলে সুউচ্চ আবাসন প্রকল্পের কোনো বিকল্প নেই। সেটি হচ্ছেও। তাতে ইট-পাথরের জঙ্গলে পরিণত হচ্ছে ঢাকা শহর। পাকিস্তান আমলের মাস্টারপ্ল্যানে যতটুকু সবুজের জন্য জায়গা ছাড়া হয়েছিল, সেটিও আমরা পর্যায়ক্রমে অনেকখানি নষ্ট করে ফেলেছি। সে জন্য আমরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিল্ডিং কোডের চেয়ে আর বেশি কী করা যায়, সেই চেষ্টা করছি। প্রাকৃতিক আলো-বাতাস ও সবুজায়নের প্রতি বেশি জোর দিচ্ছি। সেটিকে মাথায় রেখে আমরা জমি নেওয়ার চেষ্টা করি। নকশাও সেভাবেই করা হয়।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ঢাকায় ফ্ল্যাটের দাম অনেক আগেই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। সেটিকে সাধ্যের মধ্যে আনার কোনো উপায় কি আছে?

হোসেন খালেদ: আবাসন প্রকল্পে আমরা যে ধরনের মূল্যে কাজ করছি, তাতে সমাজের বড় একটি গোষ্ঠীকে স্পর্শ করতে পারছি না। তাঁদের ক্রয়ক্ষমতার ধারেকাছেও আমরা যেতে পারছি না। এটির বেশ কয়েকটি কারণও আছে। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে সবচেয়ে আগে গ্যাস নয়, ফুরিয়ে যাবে জমি। সে জন্য জমির দাম অনেক বেশি। আমাদের আবাসন প্রকল্পের ব্যয়ের বড় অংশই যায় জমির পেছনে। তারপর নির্মাণসামগ্রীর ব্যয়। তবে প্রকল্প বড় হলে খরচ কিছুটা কমানোর সুযোগ থাকে। অধিকাংশ মানুষের কর্মসংস্থান, স্কুল-কলেজ, মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ঢাকা শহরকেন্দ্রিক। এসব সুযোগ-সুবিধা যত তাড়াতাড়ি অন্য শহরে নেওয়া যাবে, ততই ঢাকার ওপর চাপ কমানো যাবে। ঢাকার ওপর চাপ কমে এলে ফ্ল্যাটের দামও কমবে। তা ছাড়া গৃহঋণের মেয়াদ ১০ বছর থেকে ২০ বছরে নিয়ে যেতে হবে। তার জন্য নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। কারণ, মাসিক কিস্তির পরিমাণ কমিয়ে আনতে না পারলে ফ্ল্যাটের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে না। ব্যাংকের ঋণের সুদের হার কমানোর পরও ৯ শতাংশ রয়েছে। বাংলাদেশের ব্যাংকের পুনঃ অর্থায়ন তহবিলের মাধ্যমে এই সুদের হার অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। এই তিন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনেক মানুষের আবাসনসুবিধা নিশ্চিত হয়ে যাবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: করোনায় তো সবকিছু ওলটপালট। বর্তমান পরিস্থিতিতে আপনারা টিকে থাকতে ব্যবসায়িক কৌশলে কী ধরনের পরিবর্তন আনছেন?

হোসেন খালেদ: করোনার কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যবসায়িক কৌশল চূড়ান্ত করার চেষ্টা করছি। কারণ, অনেক কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। বর্তমানে আবাসনের চাহিদা কমছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাহিদা বাড়ছেও। আমেরিকা-কানাডার মতো দেশের আবাসন খাত এখন রমরমা। সেখানে বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের চাহিদা বেশি। অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বব্যাপী উচ্চবিত্তের ভোগ ব্যয় বেড়েছে। আবার মধ্যবিত্তের বাড়ির চাহিদা বেড়েছে। কারণ, অনেকেই ঘরে বসে কাজ করছেন। বাংলাদেশেও সেটির প্রভাব রয়েছে। যাঁরা আগামী দিনে বাড়ি কেনার পরিকল্পনা করেছিলেন, তাঁরা সেটিকে এগিয়ে নিয়ে এসেছেন। আবাসন খাতে অল্প মার্জিনে বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। বর্তমানে আমরা ভ্যালু এডিশন করে টিকে থাকার চেষ্টা করছি। যেহেতু নির্মাণসামগ্রীর গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপাদান আমরা নিজেরা উৎপাদন করি, তাই আমরা সরবরাহব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। সে জন্য আমরা ক্রেতাদের বেনিফিট দিতে পারি। বড় প্রকল্পের কাজ করলে খরচ কমে। বেশি মানুষের কাছেও পৌঁছানো যায়।