তিন বছর ধরে বাণিজ্য নেই

এনবিআর ফেব্রুয়ারিতে ১৩৪টি শুল্ক স্টেশন বিলুপ্ত করে কার্যকর বলে ৫৭টি রেখে দেয়। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে ২৬টি দিয়ে আমদানি-রপ্তানি হয় না।

বহুকাল ধরে কোনো রকম আমদানি-রপ্তানি না হওয়ায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চার মাস আগে ফেব্রুয়ারিতে ১৩৪টি শুল্ক স্টেশন বিলুপ্ত ঘোষণা করে। সংস্থাটি আমদানি–রপ্তানির সম্ভাবনা বিবেচনায় বাকি ৫৭টি শুল্ক স্টেশনকে কার্যকর রাখা হয়। কিন্তু ওই ৫৭টির মধ্যে ২৬টি শুল্ক স্টেশন দিয়েও গত তিন বছরে কোনো পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়নি। এমনকি এর অনেকটি দিয়ে নিকট ভবিষ্যতেও আমদানি-রপ্তানির সম্ভাবনা নেই।

তাই এসব শুল্ক স্টেশনগুলো কার্যকর রাখায় প্রশ্ন উঠেছে। এর মধ্যে কয়েকটি রেল ও নৌপথের শুল্ক স্টেশনও আছে। এসব শুল্ক স্টেশনের অধিকাংশেরই কোনো অবকাঠামো নেই।

এনবিআরের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনেই এমন চিত্র উঠে এসেছে। সে অনুযায়ী যেসব শুল্ক স্টেশন দিয়ে গত তিন বছরে এক টাকার বাণিজ্য হয়নি সেগুলো হচ্ছে, খুলনার কয়রার রায়মঙ্গল, খুলনা, চুয়াডাঙ্গার দৌলতগঞ্জ, মেহেরপুরের মুজিবনগর, রাজশাহীর সুলতানগঞ্জ, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরা, নওগাঁর ধামইর, নীলফামারির চিলাহাটি, কুড়িগ্রামের চিলমারী, নুনখাওয়া, মানিকগঞ্জের আরিচাঘাট, সুনামগঞ্জের নোরারাই, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ, খাগড়াছড়ির রামগড়, রাঙামাটির ঠেগামুখ ও কক্সবাজার। এ ছাড়া প্রকল্প ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক কার্যক্রমের জন্য অনুমোদন পাওয়া সাতটি শুল্ক স্টেশন দিয়েও গত তিন বছরে কোনো আমদানি-রপ্তানি হয়নি। সেগুলো হচ্ছে, পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের প্রিমিয়ার এলপি গ্যাস লিমিটেড, সীতাকুণ্ডের বিএম এনার্জি লি., জেএমআই ইন্ডাস্ট্রিয়াল লি., ইউনিটেক্স এলপি গ্যাস লি. ও কক্সবজারের মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘জটের কারণে বেনাপোল স্থলবন্দরে পণ্যবাহী ট্রাক ঢোকার আগে সীমান্তের ওপারেই ১৫ থেকে ২০ দিন বসে থাকতে হয়। এপারে খালি হলেই ওপারের ট্রাক আসে। এতে ব্যবসায়ীদের খরচ বাড়ে। দেশের পশ্চিমাঞ্চলের যেসব অবকাঠামোহীন শুল্ক স্টেশন চালু আছে, সেগুলোর অবকাঠামো তৈরি হলে ব্যবসায়ীরা ব্যবহারে উৎসাহী হবেন। ওই অঞ্চল দিয়ে ভারত থেকে পণ্য আমদানি-রপ্তানির চাহিদাও আছে। এ নিয়ে আমরা একাধিকবার এনবিআরের কাছে দাবি জানিয়েছি।’

মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে সব শুল্ক স্টেশন দিয়ে সব ধরনের পণ্য আমদানির অনুমতি দেওয়া উচিত। তাহলে ব্যবসায়ীরা নিজেদের পছন্দমতো শুল্ক স্টেশন ব্যবহার করতে পারবেন।

কয়েক মাস আগেও দেশে ১৮৪টি শুল্ক স্টেশন ছিল। কাগজকলমে এসব শুল্ক স্টেশন দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানির সুযোগ ছিল। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৩৪টি শুল্ক স্টেশন বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। সক্রিয় ও কার্যকর বলে মাত্র ৫০টি শুল্ক স্টেশন দিয়ে আমদানি-রপ্তানির সুযোগ রাখা হয়।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, আঞ্চলিক যোগাযোগ ও বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য স্থলপথে বাণিজ্যের দ্বার খুলে দেওয়া উচিত। যত বেশি শুল্ক স্টেশন কার্যকর করা যাবে, ব্যবসায়ীদের তত বেশি সুবিধা হবে। তবে এভাবে বাণিজ্য করার জন্য অবকাঠামো তৈরি করতে হবে।

জানা গেছে, আমদানি-রপ্তানি হয় না এমন ৫০টি শুল্ক স্টেশনকে অকার্যকর ঘোষণা করা হয়েছিল ২০০৭ সালের ১ জুলাই। তবে পূর্বানুমতি নিয়ে এসব শুল্ক ষ্টেশন দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানির সুযোগ রাখা হয়। কিন্তু গত দেড় যুগে ওইসব শুল্ক স্টেশন দিয়ে কেউ–ই আমদানি-রপ্তানি করেননি।

২০১২ সালেও এনবিআর অকার্যকর শুল্ক স্টেশন বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়। শতাধিক শুল্ক স্টেশন বাদ দেওয়ার সুপারিশ করে একটি প্রতিবেদনও দেয় এনবিআরের গঠিত বিশেষ কমিটি। পরে সেটি নিয়ে আর অগ্রগতি হয়নি। গত দেড় বছর ধরে এনবিআরের শুল্ক কর্মকর্তারা কোন কোন স্টেশন বাদ দেওয়া হবে, তা নিয়ে কাজ করেছে। এই নিয়ে বাণিজ্য, নৌ ও পররাষ্ট্রসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক একাধিক সভায় করেছে এনবিআর। শেষ পর্যন্ত ৫০টি শুল্ক স্টেশন রাখার সিদ্ধান্ত হয়। এর সঙ্গে সাতটি শুল্ক স্টেশন প্রকল্প ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক যুক্ত করা হয়। এতে মোট সক্রিয় ও কার্যকর শুল্ক স্টেশনের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৭। এখন দেখা যাচ্ছে, এসব শুল্ক স্টেশনের মধ্যে ২৬টি দিয়ে গত ৩ বছর কোনো আমদানি-রপ্তানিই হয়নি।

এনবিআরের শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ওই ২৬টি শুল্ক স্টেশনের সম্ভাবনা আছে। কোনোটি বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের অনুরোধে শুল্ক স্টেশন ঘোষণা করা হয়েছে। আবার নৌ, রেল ও স্থলপথে ভারত, বাংলাদেশসহ আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য কয়েকটি শুল্ক স্টেশন রাখা হয়েছে। একবার কোনো শুল্ক স্টেশন বিলুপ্ত করলে তা আবার ফিরিয়ে আনতে নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দেখা দেয়।