দুর্দিনের কবলে হ্যালো মাইক্রোফোন টেস্টিং

অনুষ্ঠানে মাইক–মাইক্রোফোন, সাউন্ডবক্স, সাউন্ড মিক্সিং মেশিন ভাড়া দেওয়া এবং প্রকৌশলসংক্রান্ত সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির মুখে পড়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সভা ও সমাবেশে মাইক–মাইক্রোফোন সরবরাহ করে ইতিহাসের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে কল-রেডির নাম। প্রতিষ্ঠানটির ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের হৃষিকেশ দাস রোডের অফিসের সামনেও বড় করে লেখা রয়েছে, ‘উই ক্রিয়েট হিস্ট্রি’ (আমরা ইতিহাস সৃষ্টি করি)। অথচ এক বছর ধরে এমন একটি প্রতিষ্ঠানই কিনা মাইক–মাইক্রোফোন, সাউন্ডবক্স, সাউন্ড মিক্সিং মেশিন ভাড়া দেওয়ার কাজ পাচ্ছে না। করোনার কারণে কোথাও কোনো অনুষ্ঠান না হওয়ায় ব্যবসায়িক মন্দায় পড়েছে তারা।

আলাপকালে কল-রেডির অন্যতম স্বত্বাধিকারী সাগর ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে যখন রাজনৈতিক অনুষ্ঠান কম হতো, তখন ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও স্কুল–কলেজের অনুষ্ঠান—এসবের কিছু না কিছু তো হতো। ফলে ব্যবসা চলে যেত। করোনাকালের মতো কর্মহীন কোনো দিন হইনি।’

এদিকে দীর্ঘদিন ধরে কোনো কাজ না পাওয়ায় কল-রেডিকে ছাঁটাই করে দিতে হয়েছে কর্মীদের। খোলা রাখলে কোনো কাজ পাওয়া যেতে পারে—এই আশায় দুজন মাত্র কর্মচারী রাখা হয়েছে। তাঁদের নিয়েই প্রতিদিন দোকান খুলে বসছেন সাগর ঘোষ। বললেন, যদি একজন কর্মচারীকেও বেতন না দিতে হয়, তারপরও যন্ত্রপাতি রাখার গুদামভাড়া ও যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ মাসে খরচ আছে দুই লাখ টাকা।

কল-রেডির মতো আরেকটি প্রতিষ্ঠান ডিজে প্রো। অডিটরিয়াম বা মিলনায়তনভিত্তিক অনুষ্ঠানের প্রকৌশলসংক্রান্ত সব খুঁটিনাটি কাজ করে তারা। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী শামীম আহমেদ বলেন, শুধু রোজার মাসের কয়েক দিন ছাড়া পুরো বছরই চলত ব্যবসা। বছরে আয় হতো প্রায় ৭০ লাখ টাকা, এখন টুকটাক যা পাওয়া যায়, তা দিয়ে প্রতিষ্ঠানের খরচও ওঠে না।

মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপনের বছর হওয়ায় কল–রেডি ও ডিজে প্রোর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ২০২০-২১ সাল খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ, এই দুটি উৎসব উপলক্ষে রাজধানীতে নানা অনুষ্ঠানে মাইক–মাইক্রোফোন, সাউন্ড সিস্টেম ও সাউন্ড মিক্সিং মেশিন ভাড়া এবং এ–সংক্রান্ত প্রকৌশলসেবা দিয়ে জমজমাট ব্যবসা করার কথা। এ সময়ে দম ফেলার ফুরসতও থাকবে না এমন আশায় নতুন বিনিয়োগও করেছিল প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু করোনার থাবা থমকে দিয়েছে সবকিছু। এখন ব্যবসায় টিকে থাকাটাই কঠিন হয়ে পড়েছে।

একটা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনার কাজটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান করে থাকে। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ পুরোটাই করে প্রকৌশল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে আছে আলোকসজ্জা, মঞ্চ নির্মাণ, ক্যামেরার কাজ, এলইডি স্ক্রিন ব্যবস্থাপনা, শব্দ প্রকৌশল ইত্যাদি। আর এগুলোর সব কটিই আলাদা আলাদা খাত। সব মিলিয়ে ঢাকায় এ ধরনের হাজারখানেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একদম ছোট করে ধরলেও অনুষ্ঠান প্রকৌশলের ব্যবসায়ে ন্যূনতম ২০ লাখ টাকার বিনিয়োগের দরকার। আর প্রতিষ্ঠান বড় হলে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ হয়ে থাকে। ছোট-বড় সবাই এখন করোনার ক্ষতিতে পড়েছে।

ব্যবসায়ের ধরন আলাদা হওয়ায় অনুষ্ঠান আয়োজনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক আয় বা করোনাকালের ক্ষতির পরিমাণ জানাতে পারেননি কেউ। এসব ব্যবসায়ে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে সদ্য গঠিত হওয়া সংগঠন ইভেন্ট লজিস্টিক সাপোর্ট ফোরাম অব বাংলাদেশের (ইএলএসএফবি) সদস্যসচিব রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের একেকজনের লাইসেন্সের ধরন একেক রকমের। যেহেতু আমরা একক খাত হিসেবে এখনো প্রতিষ্ঠিত হতে পারিনি, সেহেতু ক্ষতির পরিমাণও নির্ণয় করা যায়নি। পাইনি কোনো সহযোগিতাও। তবে প্রতিদিনই বাড়ছে ক্ষতির পরিমাণ।

অনুষ্ঠান প্রকৌশল যন্ত্রের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করে থাকেন এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত যন্ত্রবিদেরা। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের বেতনভুক্ত স্থায়ী কর্মী থাকেন। এর বাইরে অনুষ্ঠান অনুযায়ী দিনমজুরির ভিত্তিতে ভাড়া করা হয় অনেক কর্মী। ইভেন্ট লজিস্টিক সাপোর্ট ফোরাম অব বাংলাদেশের (ইএলএসএফবি) তথ্য অনুযায়ী এই খাতে স্থায়ী–অস্থায়ী মিলিয়ে প্রায় এক লাখ কর্মী কাজ করেন। করোনায় তাঁদের প্রায় ৯০ শতাংশের কাজ নেই।

করোনায় কাজ হারানো কর্মী তোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে মুঠোফোনে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তোফাজ্জল জানান, গত বছরের এপ্রিলেই চাকরি হারিয়েছেন তিনি। মাঝে শুধু গত ঈদুল ফিতর উপলক্ষে প্রতিষ্ঠান কিছু টাকা দিয়েছিল। টুকটাক ব্যবসা ও ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে। বাকিও করতে হচ্ছে দোকানে।

গত এক বছরে কাজে ফিরতে না পেরে আশাহত অনেকেই বদলে ফেলেছেন পেশা। ইএলএসএফবির সদস্যসচিব রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যবসার পাশাপাশি কর্মীও হারাতে হয়েছে। সব ঠিক হওয়ার পরে আবার ব্যবসা শুরু করতে গেলে আমাদের নতুন শঙ্কার কারণ হবে দক্ষ কর্মীর সংকট।’