দেশীয় কৃষি যন্ত্রপাতি পিছিয়ে আছে

দেশের কৃষিকাজে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার প্রতিবছরই বাড়ছে। আমদানিকৃত কৃষিযন্ত্রের পাশাপাশি দেশীয় যন্ত্রও জনপ্রিয় হচ্ছে। তবে সম্ভাবনা থাকার পরও দেশীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো একটা পর্যায়ে এসে আটকে আছে। অগ্রগতি হচ্ছে ধীর গতিতে। ফলে কৃষিযন্ত্রের বাজারের বিশাল অংশ এখনো আমদানিনির্ভর।
স্থানীয় উদ্যোক্তাদের কাছে আমদানি কিংবা দেশে উৎপাদিত কৃষি যন্ত্রপাতির পরিমাণবিষয়ক কোনো সঠিক তথ্য-উপাত্ত নেই। উদ্যোক্তারা বিভিন্ন সময়ে দাবি করেছেন যে তাঁরা স্থানীয় চাহিদার ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত জোগান দিচ্ছেন। কিন্তু সম্প্রতি খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, এই তথ্য বিভ্রান্তিকর। চাহিদার একটি বড় অংশ এখনো আমদানিনির্ভর।
অবশ্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আনুমানিক একটি হিসাব দিয়ে বলেছে, দেশে কৃষি যন্ত্রপাতির অভ্যন্তরীণ বাজার বর্তমানে প্রায় নয় হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে মাত্র ২০-২৫ শতাংশ হচ্ছে দেশীয় উৎপাদকদের তৈরি পণ্য।
অবশ্য পরিমাণের দিকে পিছিয়ে থাকলেও মানের ক্ষেত্রে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের তৈরি যন্ত্রপাতি আমদানি করা পণ্যের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। ইতিমধ্যে কয়েকটি দেশে কৃষিযন্ত্র রপ্তানিও হয়েছে। আছে আরও অনেক সাফল্য।
এমন দাবি করে এ খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কয়েকটি কারণে অগ্রগতি ধীর হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, যন্ত্রাংশ আমদানিতে উচ্চ শুল্ক দিতে হয় স্থানীয় উৎপাদকদের। তার বিপরীতে বিদেশ থেকে সম্পূর্ণ তৈরি যন্ত্র আনতে শুল্ক কম। ফলে বিদেশি যন্ত্রের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় পড়ছে দেশি পণ্য। এ ছাড়া প্রযুক্তিবিষয়ক গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদসহ নানা জটিলতার কথাও বললেন উদ্যোক্তারা।
এসব সমস্যা সমাধানসহ খাতটির বিকাশে সরকারকে ‘সিরিয়াস’ হতে হবে বলেও মনে করেন একাধিক উদ্যোক্তা। তাঁরা বলেন, তাহলেই সম্ভাবনাময় এই শিল্প খাতটিকে অনেক দূর এগিয়ে নেওয়া যাবে। এতে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন কৃষকেরা। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় করা সম্ভব।
কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক সমিতির বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১৪। অবশ্য এর বাইরেও আছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান পাওয়ার টিলার থেকে শুরু করে সেচযন্ত্র, ধান-গম কাটার যন্ত্র, ধান মাড়াই ও ঝাড়াই যন্ত্র, গম মাড়াই, ভুট্টা মাড়াই, ধান-গম শুকানোর যন্ত্র, নিড়ানি যন্ত্র, গাছের পোকা-মাকড় দমনে কীটনাশক ছিটানোর যন্ত্র ইত্যাদি তৈরি করছে। আর প্রতিষ্ঠানগুলো রাজধানীর পুরান ঢাকা, সিলেট, কিশোরগঞ্জ, বগুড়া, দিনাজপুর, চুয়াডাঙ্গা ও যশোরে বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা জানান, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ও ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) নিজস্ব গবেষণায় যেসব যন্ত্র উদ্ভাবন হয়েছে, তার থেকে ১২-১৪টি কৃষিযন্ত্র এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। নকশা অনুযায়ী স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এগুলো তৈরি করে কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেয়। পাশাপাশি তারা নিজেরাও ১০-১২টি যন্ত্র উদ্ভাবন করেছে।
অবশ্য নতুন যন্ত্রাংশ তৈরির চেয়ে উদ্ভাবিত যন্ত্রপাতির মান উন্নয়নে বেশি জোর দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি গোলাম রব্বানী চৌধুরী। তিনি বলেন, দেশে তৈরি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিত করতে প্রচারণার অভাব রয়েছে। সে জন্য আবিষ্কৃত যন্ত্রগুলো এখনো সঠিকভাবে বাজারে পরিচিত করানো যায়নি। এ ক্ষেত্রে সরকারি সহযোগিতা বিশেষভাবে প্রয়োজন।
দেশীয় প্রযুক্তিতে কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরিতে বড় প্রতিষ্ঠান সিলেটের আলীম ইন্ডাস্ট্রিজ। তবে নব্বইয়ের দশকে চা শিল্পের পড়তি দেখে কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি শুরু করেন প্রয়াত এম এ আলীম চৌধুরী। তাঁরাই প্রথম দেশে মাড়াইকল উদ্ভাবন করেন। এর স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯২ সালে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পায় প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে মাড়াইকল ছাড়াও পাওয়ার টিলার, পাওয়ার রিপার বা শস্য কাটার যন্ত্র, শস্য পরিষ্কার ও বীজ পৃথক্করণ যন্ত্র, ড্রাম সিডার বা শস্য বোনার যন্ত্রসহ ২০-২২ ধরনের কৃষিযন্ত্র তৈরি হয় আলীমের কারখানায়।
কৃষি যন্ত্রপাতি বিক্রি করেই গত বছর প্রতিষ্ঠানটি ৩৫ কোটি টাকা আয় করে। প্রতিষ্ঠানটিতে সরাসরি কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা ৩০০। পাশাপাশি বিভিন্ন সংযোজক যন্ত্রাংশ তৈরি করে এমন তিন হাজার ব্যক্তি তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। দেশের বাজারের পাশাপাশি ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্য, পূর্ব তিমুর ও মেক্সিকোতে আলীমের যন্ত্রপাতি রপ্তানি হয়েছে।
আলীম ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলীমুল এহসান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সম্পূর্ণ তৈরি কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানি করতে শুল্কের পরিমাণ যেখানে ৫ শতাংশের কম, সেখানে খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানিতে ৩০-৪৫ শতাংশ হারে শুল্ক ও অগ্রিম আয়কর দিতে হয়। এ জন্য উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। একই সঙ্গে আমদানিকৃত যন্ত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা সক্ষমতাও কমে।
উদাহরণ দিয়ে আলীমুল এহসান বলেন, বর্তমানে শস্য কাটার একটি যন্ত্রের (পাওয়ার রিপার) দাম এক লাখ ৩০ হাজার টাকা। তবে যন্ত্রাংশ আমদানি শুল্কমুক্ত করা হলে সেটি এক লাখ টাকাতেই পাওয়া সম্ভব। একইভাবে অন্যান্য যন্ত্রের দামও উল্লেখযোগ্য হারে কমবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আলীমের মতো বড় আকারে না হলেও চুয়াডাঙ্গার জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরিতে ভালো সাফল্য দেখাচ্ছে। শস্য ঝাড়াই, ভুট্টা মাড়াই, কাদা পরিষ্কার, বীজ বপনসহ বেশ কয়েক ধরনের যন্ত্র তৈরি করছে তারা। প্রতিবছর গড়ে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার কৃষি যন্ত্রাংশ বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে এখানে কাজ করেন প্রায় ৩১ জন কারিগর।
জনতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্বত্বাধিকারী মো. ওলি উল্লাহ বলেন, ‘আমাদের যন্ত্রের ব্যাপক চাহিদা আছে। তবে মূলধনের অভাবে জোগান দিতে পারছি না।’ তিনি বলেন, ‘আমি যদি আরও দুই-আড়াই কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে পারতাম, তাহলে বিক্রি দ্বিগুণ করা যেত। কিন্তু ব্যাংক ঋণের সুদের হার অনেক বেশি। তা ছাড়া জামানত হিসেবে ব্যাংকের দাবি করা সম্পদ আমার মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর কাছে নেই।’
পুরোনো এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এ খাতে নতুন করে বিনিয়োগে আসার পরিকল্পনা করছে একাধিক প্রতিষ্ঠান। এমনই একটি প্রতিষ্ঠান এসিআই মটরস। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, গভীর নলকূপ, ডিজেল ইঞ্জিন, ধান-গম কাটা ও ঝাড়াসহ বিভিন্ন কৃষিযন্ত্র আমদানি করে দেশে বাজারজাত করে। দেশীয় উৎপাদকদের তৈরি কয়েকটি যন্ত্রও বিক্রি করে এসিআই।
প্রতিষ্ঠানটির সহকারী ব্যবস্থাপক মুনেম শাহরিয়ার জানান, গত অর্থবছর ১৮০ কোটি টাকার কৃষি যন্ত্রপাতি বিক্রি করেছে এসিআই। এর মধ্যে দেশীয় উৎপাদকদের যন্ত্রপাতি ৩০ কোটি টাকার, আর বাকি ১৫০ কোটি টাকা বিদেশি যন্ত্রপাতি। তিনি আরও জানালেন, আগামী বছর দেশেই কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরির জন্য কারখানা দেওয়ার পরিকল্পনা আছে তাদের।
এদিকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বর্তমানে তিন দিনব্যাপী কৃষিপণ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সংরক্ষণে ব্যবহৃত হওয়া নানা ধরনের যন্ত্রপাতি নিয়ে একটি প্রদর্শনী চলছে। এখানে অংশ নেওয়া একাধিক উদ্যোক্তা বলেন, দেশীয় যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়াতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে এবং আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে হবে।
অবশ্য এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা শেখ মো. নাজিম উদ্দিন বলেন, খাতটি ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। এই খাতের উন্নয়নের জন্য সরকার কাজ শুরু করেছে। তিনি বলেন, সবার আগে আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেই কেবল আমদানিকে নিরুৎসাহিত করা হবে। না হলে বিপদে পড়বেন কৃষকেরা।
দেশে তৈরি কয়েকটি কৃষি যন্ত্রপাতি
পাওয়ার রিপার
ধান, গম, সরিষা, সয়াবিন ইত্যাদি শস্য সহজে কাটার যন্ত্র
পাওয়ার টিলার
শুকনো জমি চাষের জন্য, দৈনিক ১০-১২ বিঘা জমি চাষ করা যায়
শস্য ঝাড়াই যন্ত্র
মাড়াই করার পর শস্য ঝাড়া ও পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহৃত হয়
ভেনটিলেটিং
ড্রায়ার
ধান, গম, ভুট্টা, বীজ ও অন্যান্য শস্য শুকানোর যন্ত্র
মাড়াইকল
ধান ও গম মাড়াই করে শতভাগ খড় আলাদা করা যায়
ড্রাম সিডার
বীজ বপনের এই যন্ত্র প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে ৫০-৮০
ভাগ বীজ সাশ্রয়ী
 কৃষি যন্ত্রপাতির বাজার এখনো আমদানিনির্ভর
 স্থানীয় উদ্যোক্তাদের প্রধান বাধা যন্ত্রাংশ আমদানিতে উচ্চ শুল্ক
 এ খাতের উন্নয়নে সরকারকে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান উদ্যোক্তাদের