নিসর্গে আরিফুর রহমানের অতিথিসেবা

হবিগঞ্জের দ্য প্যালেস লাক্সারি রিসোর্ট

চারদিকে কেবল সবুজ আর সবুজ। পাহাড় আছে, গিরিখাত আছে, আবার লেকও আছে। জায়গাটা যেন প্রকৃতি নিজ হাতে সাজিয়েছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিছু মানুষের স্বপ্ন আর পরিকল্পনা। জায়গাটা হলো সিলেটের দ্য প্যালেস লাক্সারি রিসোর্ট। আর যাঁদের পরিকল্পনায় এই রিসোর্ট, তাঁদেরই একজন আরিফুর রহমান।

আরিফুর রহমানের পড়াশোনা সিলেট ক্যাডেট কলেজে, ভর্তি ১৯৮৩ সালে। সিলেট মানেই তো চা–বাগান। ক্যাডেটজীবনের পুরোটা সময় কেটেছে চা-বাগানের পাশেই। ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হয়ে সেনা কর্মকর্তা হতে মিলিটারি একাডেমিতে যোগ দিলেও সেখানে আর থাকা হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়ে ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রদায়ক হিসেবে কয়েক দিন কাজ করে আবার সেই চা–বাগানেই চাকরি। এবার শ্রীমঙ্গলের সিন্দুরখান আর রাজঘাটে জেমস ফিনলের চা-বাগানে সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করা। তখন থেকেই চা–বাগানকেন্দ্রিক পর্যটনের স্বপ্ন দেখা শুরু। চা–বাগানের চাকরি ছেড়ে দিয়ে হলেন বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তা। এই খাতে তাদের রপ্তানির পরিমাণ বছরে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।

কিন্তু চা–বাগানের পাশে কিছু একটা করার স্বপ্নটা মাথাতেই ছিল। সেই স্বপ্ন পূরণে ব্যবসায়িক অংশীদার আব্দুস সালামকে নিয়ে রিসোর্ট করার জন্য জায়গা খুঁজতে লাগলেন আরিফুর রহমান। হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার পুটিজুরী বাজারের জায়গাটির সন্ধান পেয়েছিলেন ক্যাডেট কলেজেরই সাবেক রুমমেট তাপসের কাছ থেকে। জায়গাটি পাহাড় আর অরণ্যঘেরা, হবিগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলের সীমান্তে। পুরোটা ছনখোলা আর অল্প কিছু লেবু–আনারসের বাগান। কিছু রাবারগাছও আছে। অনেক ঘুরে যেতে হয় হাঁটাপথে। গাড়ির রাস্তা নেই। এমনকি বিদ্যুৎ, পানিও নেই। পুরো জায়গার মধ্যে ৭৬ দশমিক ৭৪ একর জমি ছিল ক্যাডেট কলেজেরই এক বড় ভাই মো. কামাল হোসেন ও তাঁর আত্মীয়স্বজনদের নামে। তবে পছন্দ হওয়া জমির সবটুকু তাদের নয়। ফাঁকে ফাঁকে আছে প্রায় ২৪ দশমিক ১১ একর জমি। সব জমি কেনা হলো কোম্পানির নামে। সেই ১০০ দশমিক ৮৫ একর জায়গার ওপরই আজকের দ্য প্যালেস লাক্সারি রিসোর্ট, যার মূল কোম্পানি গ্রিন প্ল্যানেট রিসোর্ট লিমিটেড।

আরিফুর রহমান
প্রথম আলো

আরিফুর রহমান জানালেন, প্রথম থেকেই চিন্তা ছিল সব গাছ রেখেই প্রকল্প তৈরি হবে। কোনো গাছ তো কাটা হবেই না, বরং নতুন করে আরও লাগানো হবে। রিসোর্টের নকশা তৈরি ও নির্মাণকাজের জন্য দেশের কয়েকজন স্থপতি তো ছিলেনই, সহায়তা নেওয়া হয় চীনের স্থপতিদেরও। শুরুতেই রিসোর্টে যেতে ৪ দশমিক ১ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করতে হয়েছে। রাস্তাটা আঁকাবাঁকা এবং চা-বাগানের ভেতর দিয়েই গিয়েছে। এরপর আস্তে আস্তে পাওয়া যায় পল্লী বিদ্যুৎ। পরে অবশ্য গ্যাস জেনারেটর দিয়ে নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। গ্যাস জেনারেটরের কুলিং সিস্টেমের পানিকে এখন ভিন্ন প্রক্রিয়ায় গরম পানির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, যাতে পরিবেশের ওপর প্রভাব না ফেলে। এমনকি দৃষ্টিসীমায় সবুজের বাইরে কিছু যেন চোখে না পড়ে, সে জন্য রিসোর্টজুড়ে মাটির নিচ দিয়ে তার টানা হয়েছে। প্রতিটি কাজেই সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সহায়তা পেয়েছেন তাঁরা। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ অনেকেরই সহমর্মিতার কথা জানালেন আরিফুর রহমান।

পুরো রিসোর্ট এলাকা ৩৭-৩৮ হাজার গাছে ভরপুর। রিসোর্টটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে পরিবেশ নষ্ট না হয়। পাহাড়ের সঙ্গে পাহাড়ের সংযোগ করতে হয়েছে স্টিলের ব্রিজ দিয়ে। বিদ্যুতায়ন করা হয়েছে মাটির নিচ দিয়ে, যাতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভারসাম্য থাকে। এই সব কাজের পুরোটাই দেখেছেন আরেক সহযাত্রী আব্দুস সালাম। অসাধারণ সৌন্দর্য আর পরিবেশসচেতনতার সরকারি স্বীকৃতি মিলেছে। রিসোর্টের মূল কোম্পানি ২০১৪ সালে বৃক্ষরোপণে ‘প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার’ অর্জন করেছে। এটি পাঁচ তারকার রিসোর্ট হিসেবেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের লাইসেন্স পেয়েছে।

আরিফুর রহমান বললেন, ‘প্রথমে আমাদের অন্য রকমভাবে অল্প বিনিয়োগে রিসোর্ট করার পরিকল্পনা ছিল। কাজের মাঝামাঝি এসে বুঝতে পারি আমরা যা বানাচ্ছি, তা খুব ব্যয়বহুল। এমন একটা কাজের জন্য সাহস নয়, তার থেকে আরও বেশি কিছুর দরকার। আমরা যখন বুঝতে পারি খুব ভালো কিছু একটা হচ্ছে, তখন এত ব্যয়, এত শ্রম সবকিছুই আনন্দে পরিণত হয়েছে। আমরা এমন কিছু চাচ্ছিলাম যেন কারও রিসোর্টের ভেতরে ঢুকে দু–তিন দিন আর বের হতে না হয়। অতিথিরা সিনেমা দেখবেন, সাঁতার কাটবেন, মাছ ধরবেন, সবুজে হাঁটবেন, সাইক্লিং করবেন—এ রকম নানা আনন্দযজ্ঞ রেখেছি আমরা। একই সঙ্গে কেউ যদি নিজের মতো থাকতে চায়, সিনেমা দেখতে চায়, তারও পুরো আয়োজন আছে এতে। বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ একটি ম্যুরাল মূল চত্বরে স্থাপন করা হয়েছে।

৭৬ দশমিক ৭৪ একর জমি ছিল ক্যাডেট কলেজেরই এক বড় ভাই মো. কামাল হোসেন ও তাঁর আত্মীয়স্বজনদের নামে। তবে পছন্দ হওয়া জমির সবটুকু তাদের নয়। ফাঁকে ফাঁকে আছে প্রায় ২৪ দশমিক ১১ একর জমি। সব জমি কেনা হলো কোম্পানির নামে। সেই ১০০ দশমিক ৮৫ একর জায়গার ওপরই আজকের দ্য প্যালেস লাক্সারি রিসোর্ট

আরিফুর রহমান জানালেন, অসাধারণ এই সবুজে শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা কোভিড সময় বাদ দিয়ে পাঁচ বছর ধরে বর্ষায় গান গেয়ে যাচ্ছেন। এই প্রকল্পে এ পর্যন্ত মোট ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। এর প্রায় ৬০ শতাংশ অর্থই ঋণ হিসেবে নেওয়া হয় রূপালী ব্যাংক থেকে। কোভিডের এই সময়েও ব্যাংকঋণ নিয়মিত পরিশোধ করার তথ্য দিয়ে আরিফুর রহমান বলেন, ‘আমাদের মতো দেশে ঢাকা কিংবা বিভাগীয় শহরের বাইরে একদম গ্রামপর্যায়ে হসপিটালিটি ব্যবস্থাপনা অনেক কঠিন। অনেক গুজব এবং ভুল ধারণা অনেককে ঘিরে থাকে। তারা আয়-ব্যয় নিয়ে নিজের মতো করে বিভিন্ন গল্প করতে পছন্দ করেন, যার বেশির ভাগ ভুল এবং অসত্য।’

গ্রিন প্ল্যানেট রিসোর্টের অংশীদার এখন ছয়জন। তারা হলেন মো. কামাল হোসেন, লিনা খাতুন, আব্দুস সালাম, আব্দুল আওয়াল, ইকবাল ও আরিফুর রহমান। অতিথিরা এসে এসে কী প্রতিক্রিয়া দেখান? আরিফুর রহমান জানান, ‘অতিথিরা বিভিন্ন জায়গার রিভিউ দেন, সেই রিভিউর ওপর ভিত্তি করে ট্রিপ অ্যাডভাইজ দুনিয়াজুড়ে ঠিক করে কারা “সার্টিফিকেট অব এক্সিলেন্স” পাবে। ২০১৮ সাল থেকেই রিসোর্ট ক্যাটাগরিতে ট্রিপ অ্যাডভাইজের এই সার্টিফিকেট পাচ্ছে দ্য প্যালেস। এমনকি গত বছর আমরা সুপার ব্র্যান্ড হয়েছি।’

আরিফুর রহমান মনে করেন, ‘দেশের চা-বাগানের সৌন্দর্যের কিছুই এখনো পুরোপুরি উন্মোচিত হয়নি। সবুজ ও পরিবেশবান্ধব প্রকল্প করার জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা আর হয় না। পৃথিবীর অনেক রিসোর্টে যাওয়ার জন্য লোকজন উন্মুখ হয়ে থাকে। আমি স্বপ্ন দেখি দ্য প্যালেস সেই মানের একটা গন্তব্য হবে। সিলেটের জাফলং দিয়ে এশিয়ান হাইওয়ে যেটা আসছে, সেটা এই রিসোর্টের পাশ দিয়েই যাবে। বিদেশিরাও আসবেন আমাদের পাশাপাশি। আবার ঢাকা-সিলেট চার লেনের কাজও শুরু হয়েছে। যখন এটা শেষ হয়ে যাবে তখন ঢাকা থেকে খুব অল্প সময়ে সেখানে যাওয়া যাবে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের পাশে গ্রাম এবং চা-বাগানে যে জনগোষ্ঠী আছে, তাদের জীবনমান উন্নত হতে থাকবে। এভাবেই এগিয়ে যাবে দেশ—বাংলাদেশ।