পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক ও একটি বাড়ি একটি খামার নিয়ে বিপাক
পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক ও ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প নিয়ে হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক আইন প্রণয়ন করে গত জুনে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পটি বিলুপ্ত করেছে সরকার। একই মাসে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক যাত্রা শুরু করেছে।
আর এই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আইন সংশোধন করে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর চিন্তা করছে। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগও এতে রাজি। কিন্তু অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সম্মতি নেই এতে। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান মিহির কান্তি মজুমদারও চান না বিলুপ্ত প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ুক।
এ অবস্থায় পুরো বিষয় নিয়েই জটিলতা দেখা দিয়েছে। এতে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের কার্যক্রমে যেমন স্থবিরতা চলছে, প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত থাকা ব্যক্তিরাও রয়েছেন অনিশ্চয়তায়।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৯৯৬ সালের শাসনামলে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে তা বন্ধ করে দেয়। আওয়ামী লীগের বর্তমান আমলে আবার চালু হয় এ প্রকল্প। ২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২২ জুন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। ব্যাংকটি মূলত ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পেরই পরবর্তী রূপ। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয় গত ৩০ জুন। তার আগে ২২ জুন ১০০ শাখা নিয়ে যাত্রা শুরু করে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক।
এ অবস্থায় গত ৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সমন্বয় এবং উন্নয়ন-সংক্রান্ত একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য দূরীকরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগ একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক।
ওই সভায় সাতটি সিদ্ধান্ত হয়। সেগুলো হচ্ছে প্রকল্পটির সম্প্রসারণ কার্যক্রম অব্যাহত রাখা, প্রকল্পের পরিণত সমবায় সমিতিগুলোর দায়িত্ব পল্লী সঞ্চয় ব্যাংককে দেওয়া, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের অনুমোদিত ৪৮৫টি শাখার কার্যক্রম যত দ্রুত সম্ভব চালু করা, ব্যাংক ও প্রকল্প একসঙ্গে চালু রাখা, ব্যাংক ও প্রকল্পের সমন্বয় ও মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম শুরুর ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী ও এলজিআরডি মন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্য সচিবের আলাপ করা।
এ ছাড়া প্রকল্পের মেয়াদ ২০২০ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধির ব্যাপারে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক আইনের সংশোধন করতে হতে পারে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পের সমিতিগুলোকে সমবায় অধিদপ্তরে নিবন্ধন করার ফলে যদি দ্বৈত ব্যবস্থাপনা দেখা দেয়, তাহলে বিষয়টি পরবর্তী উপদেষ্টা কমিটিতে উপস্থাপন করতে হবে।
এরপর সচিবালয়ে গত ২২ সেপ্টেম্বর পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগে আরেকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব চিন্তাপ্রসূত একটি দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্প। এর মাধ্যমে প্রচলিত ক্ষুদ্রঋণের পরিবর্তে দরিদ্র মানুষের ক্ষুদ্র সঞ্চয় ও সরকারি সহায়তায় দেশের ৪০ হাজার ৫২৭টি ওয়ার্ডে ৪০ হাজার ২১৬টি গ্রাম উন্নয়ন সংগঠন তৈরি করে প্রায় ২০ লাখ দরিদ্র পরিবারের জন্য স্থায়ী তহবিল গঠন করে দেওয়া হয়েছে।
কার্যবিবরণীতে আরও বলা হয়, দরিদ্র মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি এবং আরও ৬০ হাজার ৫১৫টি গ্রাম সংগঠন করা তথা আরও ৩৬ লাখ পরিবার অন্তর্ভুক্ত করে প্রকল্পের তৃতীয় সংশোধনী প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে, যা একনেকের চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায়।
প্রকল্পে সদস্যদের নিজস্ব সঞ্চয় ৯৭০ কোটি ২২ লাখ টাকা এবং সরকার দিয়েছে ১ হাজার ৯৫৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে মোট তহবিলের পরিমাণ ৩ হাজার ৫৩ কোটি টাকা।
জানা গেছে, অর্থমন্ত্রী গত ২৪ সেপ্টেম্বর বিদেশে যাওয়ার আগের কর্মদিবসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিদ্ধান্তের কপি নিয়ে সচিবালয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান মিহির কান্তি মজুমদার। সাত সিদ্ধান্তের দুটির বিষয়ে মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী।
পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক ও একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘দুটো একসঙ্গে চলতে পারে না।’ আর আইন সংশোধন নিয়ে বলেন, ‘এখনই আইন সংশোধনের প্রয়োজন কী?’
যোগাযোগ করলে মিহির কান্তি মজুমদার বলেন, ‘একটি সমিতিও সমবায় সমিতি হিসেবে নিবন্ধিত হয়নি। সমিতিগুলোর নিরীক্ষা, বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) ও নির্বাচন হচ্ছে না এবং এগুলোর নিজস্ব কোনো তহবিলও গঠিত হয়নি।’
প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লে সমিতিগুলো দুর্বল হবে এবং পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ক্ষতি হবে বলেও মনে করেন মিহির কান্তি মজুমদার।
তবে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়সচিব প্রশান্ত কুমার রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘দারিদ্র্য বিমোচনে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প যে ভূমিকা রাখছে, আমি মনে করি এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন। প্রকল্পটির মেয়াদ বৃদ্ধি তাই জরুরি।’