
সড়ক থেকে আড়াই-তিন ফুট ওপরে আনুমানিক চার ফুট বাই ছয় ফুট আকারের ছোট টং দোকান। বাদল মোটরস। ছোট্ট দোকানজুড়ে গাড়ির বিভিন্ন ধরনের নাটবল্টু। ডালায় সেগুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দেয়ালে ও ছাদের প্রায় সবখানে মালার মতো গাঁথা নাটবল্টু। এক পাশে বসে আছেন দোকানের মহাজন শ্মশ্রুমণ্ডিত জামাল হোসেন।
ধোলাইখালের সঙ্গে জামাল হোসেনের সম্পর্ক প্রায় ৪০ বছরের। সেই হাফপ্যান্ট পরার বয়সে দোকানে কাজ শুরু করেন। পরে নিজের পুঁজিতে দোকান দিয়েছেন। গত রোববার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ধোলাইখালের বিখ্যাত টং মার্কেটে ঢুকতেই তাঁর সঙ্গে কথা। বললেন, ‘গাড়ির সব ধরনের নাটবল্টুই আছে আমার কাছে। সবই রিকন্ডিশন্ড, মানে পুরান গাড়ির।’
স্থানীয় দোকানদারদের কাছ থেকেই নাটবল্টু সংগ্রহ করেন জামাল হোসেন। তবে চাহিদা থাকায় নতুন নাটবল্টু অল্প পরিমাণে রাখছেন এখন। তিনি বলেন, ‘আগের চেয়ে দোকানের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। তারপরও ভালো-খারাপ মিলিয়েই ব্যবসা চলছে।’
পুরান ঢাকার ধোলাইখালে কেবল এই নাটবল্টু নয়, গাড়ির পুরান লাইট, আয়না, বিয়ারিং, পাখা, স্প্রিং, ব্রেক, বুস্টার, হ্যাঙ্গার, হুইল, টায়ার—সবই চাহিদা অনুযায়ী অল্প দামে পাওয়া যায়। দেশে গাড়ির সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানকার দোকান ও ব্যবসা—দুই-ই বেড়েছে। মূল সড়ক ছাড়িয়ে আশপাশের বিভিন্ন অলিগলিতে ঢুকে গেছে পুরোনো গাড়ির যন্ত্রাংশের এই ব্যবসা। অধিকাংশ দোকানই এত ছোট যে তাদের যন্ত্রপাতি উপচে বেরিয়ে এসেছে ফুটপাতে কিংবা সড়কের ওপর। বর্তমানে হাজার পাঁচেক দোকান আছে ধোলাইখালে।
ফুটপাতের ওপর ফেলে রাখা হয়েছে গাড়ির পুরোনো ইঞ্জিন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ইঞ্জিনের নাটবল্টু খুলে সব যন্ত্রাংশ আলাদা করে ফেললেন শ্রমিকেরা। ইঞ্জিন থেকে পাওয়া যন্ত্রাংশ মহাজনের হাত ঘুরে চলে যাচ্ছে আশপাশের বিভিন্ন ছোট ও মাঝারি দোকানে। ধোলাইখালে এক চক্কর দিতেই এসবের দেখা মিলল।
দেশের ভেতরে চলাচল করা পুরোনো গাড়ি এবং তার যন্ত্রাংশের পাশাপাশি আমদানি করা পুরোনো যন্ত্রপাতি বর্তমানে প্রচুর আসে ধোলাইখালে। সড়কের একাংশ আর ফুটপাত দখল করে সেসব যন্ত্রাংশের মধ্য থেকে ব্যবহারের উপযোগী পণ্যগুলো খুঁজে বের করেন শ্রমিকেরা। তাৎক্ষণিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করেন তাঁরা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এভাবেই জমজমাট থাকে ধোলাইখাল।
পুরোনো যন্ত্রপাতি থেকে ভালো পণ্য বাছাই শেষে বিক্রি করে সেলিম ব্রাদার্স। ব্যবহারের অনুপযোগী যন্ত্রাংশগুলো বিভিন্ন ইস্পাত কারখানায় বিক্রি করে তারা। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী আবদুল গাফফার বলেন, ‘প্রতিদিন এক থেকে দেড় টন লোহার যন্ত্রাংশ ঢাকার আশপাশের রি-রোলিং মিলে পাঠাই। ব্যবহারের উপযোগী যন্ত্রাংশগুলো ধোলাইখালে বিক্রি করা হয়।’ ব্যবসা কেমন চলছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চলছে ভাই, মোটামুটি।’
গাড়ির খুচরা যন্ত্রপাতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় ধোলাইখালের ফুটপাত ধরে হাঁটা বেশ মুশকিল। বিষয়টি নিয়ে অবশ্য কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। উল্টো দোকানদারদের হাঁকডাক, ‘কী লাগবে ভাই?’, ‘ভাই, কী খোঁজেন?’ এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতেই অস্থির হতে হয়।
হারুন মোটরসের ভেতরে নিবিষ্ট মনে একটি হ্যাঙ্গার (গাড়ির চাকার ওপর ব্যবহৃত হয়) ঘষে ঘষে পরিষ্কার করছিলেন মো. সাগর। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। মাদারীপুরে বাড়ি। পুরোনো যন্ত্রপাতির এই জগতে ১০ বছর ধরে কাজ করছেন। বললেন, ‘ধোলাইখালে বেতন কম। তবে উপরি ইনকাম বেশি।’ বিষয়টা কীভাবে—জানতে চাইলেও পরিষ্কার করতে চাইলেন না সাগর।
ধোলাইখালে কাজ করতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। বেশ আনন্দই লাগে। এসব বিষয়ে সাগরের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা চলল। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী জানতে চাইলে সাগরের চোখ চকচক করে উঠল। চাকরি করে টাকা জমাচ্ছেন। কর্মচারী থেকে দোকানের মালিক হওয়ার স্বপ্ন তাঁর। বললেন, ‘মহাজন তো হবই।’
ধোলাইখালের টায়ারপট্টিতে ছোট-বড় সব আকারের পুরোনো টায়ার মেলে। অনেক সময় পুরোনো টায়ারে কালো রং করে কিংবা টায়ারের ওপরের অংশ খোদাই করে নতুনের মতো আকৃতি আনার চেষ্টা করা হয়। এসব টায়ার ৮০০ থেকে ৩০০০ টাকায় বিক্রি হয়। আবার বেশি ক্ষয়ে যাওয়া টায়ার পাতলা পাউরুটির মতো কেটে বিভিন্ন কাজের জন্যও বিক্রি করা হয়।
টায়ারপট্টিতে দীর্ঘদিন ধরে পুরোনো টায়ার বিক্রি করেন রুহুল আমিন। তাঁর দোকানের নাম রিয়ামণি টায়ার সেন্টার। জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব ধরনের ক্রেতাই পুরোনো টায়ার কেনে। এসব টায়ার অনায়াসে আট-নয় মাস চলে যায়।’ তাঁর দোকানে মাসে গড়ে ৫০-৬০ পিচ টায়ার বিক্রি হয় বলে জানালেন রুহুল আমিন।
ধোলাইখালের পুরোনো যন্ত্রপাতির ব্যবসা ঘিরে পাশেই বেশ কিছু ছোটখাটো কারখানা গড়ে উঠেছে। সেখানে গাড়ির নাটবল্টুর পাশাপাশি ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী লোহার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বানানো হয়। এ বিষয়ে ধোলাইখাল টং মার্কেট ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইদুল বারী বলেন, গাড়ির যেকোনো নাটবল্টু ধোলাইখালে পাওয়া যাবে। কোনো কারণে না পাওয়া গেলে আশপাশের কারখানা ও লেদ মেশিনগুলোই ভরসা। কেবল একটি নমুনা (স্যাম্পল) দিলেই চলে।
সাইদুল বারী বলেন, ধোলাইখালে এখনো দেশি পুরোনো গাড়ির যন্ত্রাংশ বেশি আসে। ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সংস্থার দরপত্রে অংশ নিয়ে পুরোনো ভাঙাচোরা গাড়িও কেনেন। ধোলাইখালে দিনে কত টাকার লেনদেন হয়—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সঠিক কোনো পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নাই। কয়েক কোটি কোটি টাকা হতে পারে।’
চুরি বা ছিনতাই যাওয়া গাড়ির যন্ত্রাংশেরও শেষ ঠিকানা ধোলাইখাল। অভিযোগটি বেশ পুরোনো। বিষয়টি নিয়ে কৌতুক পর্যন্ত আছে। তবে ধোলাইখালে এখন আর চুরি করা গাড়ি আসে না—সাত-আটজন ব্যবসায়ী মোটামুটি গ্যারান্টি দিয়ে কথাটি বলতে চাইলেন। তাঁদের বক্তব্য, মাদকসেবীরা অনেক সময় গাড়ির লুকিং গ্লাস বা হেডলাইট খুলে নিয়ে ধোলাইখালে বিক্রি করতে চলে আসে। তবে সেগুলো ভাসমান ব্যবসায়ীরা কেনে। ভালো ব্যবসায়ীরা কেউ কেনে না।
এ বিষয়ে সাইদুল বারী বলেন, ‘চোরাই গাড়ি ধোলাইখালে বর্তমানে আসে না। সেসব বিভিন্ন ওয়ার্কশপে চলে যায়। তা ছাড়া এখানকার ব্যবসায়ীদের কঠোরভাবে বলে দেওয়া আছে, কারও কাছে চুরি করা গাড়ি পেলে তার দোকান আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হবে।’