পুরোনো জাহাজেও হাজার পণ্যের ব্যবসা

আলপিন থেকে শুরু করে জেনারেটর, রান্নাঘরের তৈজসপত্র থেকে শিল্পের কাঁচামাল—সবই বিক্রি হয় জাহাজভাঙা শিল্পে। বছরে এ বাজারের আকার প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার।

জাহাজভাঙা শিল্পের মুদ্রার এক পিঠে পরিবেশদূষণ আর দুর্ঘটনা। অন্য পিঠে বাণিজ্য। এই বাণিজ্য মূলত হরেক রকমের পণ্য বেচাকেনার। শিল্পকারখানার কাঁচামাল থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক পণ্য, কী নেই তাতে? আবার যেসব পণ্য দেশে ব্যবহারের সুযোগ নেই, সেগুলো রপ্তানিও হচ্ছে। জাহাজ কাটাকুটির এই বাণিজ্যের আকার বছরে কমবেশি ১৫ হাজার কোটি টাকার।

জাহাজের যত লোহা আছে, তার প্রায় সবই পুনর্ব্যবহার করা যায়। ক্ষতিকর বর্জ্য ছাড়া জাহাজের আর কোনো কিছুই যেন ফেলনা নয়। একটি জাহাজে যেমন থাকে বড় আকারের রসুইঘর, তেমনি থাকে নাবিকদের আবাসন, চিকিৎসা, স্টেশনারি। আবার জাহাজ চালানোর জন্য থাকে জেনারেটর ও যন্ত্রপাতি। সরল হিসাবে, আলপিন থেকে শুরু করে নাটবল্টু, রান্নাঘরের জিনিস থেকে শিল্পকারখানার কাঁচামাল—এমন হাজারো পণ্য থাকে পুরোনো জাহাজে।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে যত জাহাজ আমদানি হয়েছে, তার শুল্ক-করসহ আমদানি মূল্য ছিল ৯ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা। জাহাজের দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকায় বাজারমূল্যও বেড়ে যায়। কয়েক মাস ধরে প্রতি টন লোহা বিক্রি হচ্ছে গড়ে ৬০০ ডলারে। এ হিসাবে শুধু লোহা বিক্রির বাজারের আকার প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার। আবার জাহাজের সরঞ্জামের বাজার দুই হাজার কোটি টাকার বেশি। এ দুইয়ে মিলিয়ে বাজারের আকার ১৫ হাজার কোটি টাকার। আমদানিকারক থেকে ব্যবহারকারী পর্যন্ত কয়েক দফা হাতবদল হয়ে বাজারের আকারও বড় হয়।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু তাহের বলেন, পুরোনো জাহাজ থেকে অসংখ্য পণ্য পাওয়া যায়। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় এখন বাজারের আকারও বেড়েছে। এখনকার হিসাবে তা ১৫ হাজার কোটি টাকার কম হবে না।

জাহাজভাঙা বাণিজ্যের প্রথম ধাপে আছেন আমদানিকারক বা ইয়ার্ডমালিকেরা। জাহাজ আমদানির পর তা বিক্রির জন্য ধারাবাহিকভাবে নিলামের আয়োজন করেন জাহাজভাঙা কারখানার মালিকেরা। ঢাকা ও চট্টগ্রামের হাজারখানেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি আছে, যারা নিলামে অংশ নেয়। নিলামে সর্বোচ্চ দরে জাহাজের পণ্য বিক্রি করেন কারখানামালিকেরা। বিক্রির পর তা জাহাজ থেকে কেটে বা পণ্য স্থানান্তর করে ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়া হয়। একেকটি বড় জাহাজ আমদানির পর বিক্রি করতে ছয় থেকে এক বছরের মতো সময় লেগে যায়।

নিলামে যাঁরা পণ্য পান, তাঁরা সরাসরি বা তাঁদের কাছ থেকে পণ্য কিনে নেন ছোট ব্যবসায়ীরা। জাহাজভাঙা পণ্য বেচাকেনা হয় ঢাকা ও চট্টগ্রামের কয়েকটি স্থানে। চট্টগ্রামের বাঁশবাড়িয়া থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত মহাসড়কের আশপাশে অসংখ্য দোকান রয়েছে, যেগুলোতে জাহাজভাঙা পণ্য বিক্রি হয়। এ ছাড়া পাহাড়তলী সিডিএ মার্কেট, সাগরিকা, পশ্চিম মাদারবাড়ী, কদমতলী ও মুরাদপুর এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন পণ্য বিক্রি হয়। ঢাকার ধোলাইখাল ও সদরঘাটেও বিক্রি হয় চট্টগ্রামের জাহাজভাঙা পণ্য।

পুরোনো জাহাজের হরেক পণ্য

একটি জাহাজের কথাই ধরা যাক। জাহাজের বেশির ভাগ অংশই লৌহজাত পণ্য। জাহাজের শরীরজুড়ে থাকা লোহা লম্বা প্লেটের আকারে কাটা হয়। এই প্লেট ব্যবহৃত হয় আধা স্বয়ংক্রিয় রড তৈরির কারখানায়। জাহাজভেদে এ হার মোট লৌহজাত পণ্যের কমবেশি ৫০ শতাংশ। আবার অভ্যন্তরীণ নৌপথের জন্য নির্মিত হওয়া অনেক জাহাজে ব্যবহৃত হয় ভাঙা জাহাজের লোহার প্লেট। এ হার বড়জোর ৫ থেকে ১০ শতাংশ। জাহাজ কাটাকুটির পর ছোটখাটো লোহার টুকরা ও লোহার যন্ত্রাংশ পাওয়া যায়। এসব লোহার টুকরা সহজেই চুল্লিতে গলানো যায়। স্বয়ংক্রিয় রড তৈরির কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় এসব লোহার টুকরা। এর পরিমাণ জাহাজের মোট লোহার ২৫-৩০ শতাংশ। এ ছাড়া সনাতন কারখানায় ব্যবহৃত হয় ১০ শতাংশ লোহার ভারী টুকরা। এ রকম অন্তত সাতটি শিল্পকারখানার কাঁচামালের জোগান আসে জাহাজভাঙা শিল্প থেকে।

জাহাজে শিল্পকারখানার কাঁচামাল ছাড়াও থাকে বাণিজ্যিক পণ্য। সম্প্রতি সীতাকুণ্ড, পাহাড়তলী সিডিএ মার্কেট, সাগরিকা রোড ও মাদারবাড়ী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পুরোনো জাহাজের পণ্য বিক্রির সারি সারি দোকান। পশ্চিম মাদারবাড়ী এলাকায় বেশির ভাগ পণ্যের মধ্যে রয়েছে লোহার পাইপ। কদমতলীতে দেখা যায় নাটবল্টুর দোকান। সাগরিকা রোডে বিক্রি হয় বড় বড় পাইপ, যন্ত্রপাতিসহ বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম। তবে বাঁশবাড়িয়া থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত মহাসড়কের পাশে সারি সারি দোকানে সব ধরনের পণ্যই বিক্রি হয়। সবই ব্যবহৃত পণ্য।

জাহাজের বড়-ছোট জেনারেটর, বৈদ্যুতিক তার বিক্রি হয় পাহাড়তলী সিডিএ মার্কেটের বিভিন্ন দোকানে। সেখানকার গাউসিয়া আয়রন মার্টে দেখা যায়, সার্কিট ব্রেকার, জেনারেটর ও তার বিক্রি হচ্ছে। ভাটিয়ারীর শীতলপুরে একটি দোকানে দেখা যায় স্তূপ করে রাখা নাটবল্টু। দোকানের মালিক শুভংকর দাস জানান, তাঁর দোকানে শুধু নাটবল্টুসহ লোহার সরঞ্জাম রয়েছে। জাহাজভাঙা কারখানা থেকে নিলামে কিনে খুচরায় বিক্রি করেন। দোকান ঘুরে রান্নাঘরের তৈজসপত্র, শোপিস, ব্যায়ামের সরঞ্জাম, এয়ারকন্ডিশনার, বৈদ্যুতিক পাখা, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, বৈদ্যুতিক তার, সাউন্ডবক্স, প্রিন্টার, ফটোকপি মেশিন, কম্পিউটার ও টেলিভিশন বিক্রি হচ্ছে।

ভাটিয়ারির আরেকটি দোকানের মালিক মো. রাসেল প্রথম আলোকে বলেন, জাহাজভাঙা কারখানা থেকে নিলামে আসবাব কিনে বিক্রি করেন তিনি। আকারভেদে একেকটি জাহাজ থেকে কয়েক লাখ থেকে কোটি টাকার ফার্নিচার নিলামে বিক্রি হয়।

বাণিজ্যিক পণ্যের পাশাপাশি অনেক পণ্য আছে, যেগুলো রপ্তানি হয়। জাহাজের সবচেয়ে দামি পণ্য হলো প্রপেলার। বড় জাহাজের প্রপেলার বিক্রি হয় কমবেশি পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকায়। তামা, পিতল, মরিচারোধী ইস্পাতের সরঞ্জামের মতো অনেক পণ্যও রপ্তানি হয়।

জাহাজভাঙা শিল্পের উদ্যোক্তারা জানান, জাহাজ আমদানি করে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫৫ থেকে ৬০টি। এই জাহাজের নানা পণ্য বেচাকেনার সঙ্গে কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠান জড়িত। জাহাজভাঙা শিল্পের বাইরে ব্যবহৃত পণ্য বেচাকেনায় বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।