বছরে সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যান বিদেশিরা

বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিকেরা বৈধ পথে বছরে প্রায় ২০০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় হিসেবে নিয়ে যান, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকার সমান। রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতে এসব বিদেশি নাগরিক কাজ করেন।

বাংলাদেশ থেকে প্রবাসী আয় বাইরে যাওয়ার এ হিসাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টার। তারা বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদদের সর্বশেষ প্রাক্কলন ধরে গবেষণাটি করেছে। গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রবাসী আয় হিসেবে ২০১৬ সালে মোট ২০১ কোটি ৩০ লাখ ডলার বিদেশে গেছে। যেসব দেশে এ অর্থ গেছে তার মধ্যে রয়েছে চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম, নেপাল, থাইল্যান্ড, জাপান, নরওয়ে ও যুক্তরাজ্য।

সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে প্রায় ৮৫ হাজার বিদেশি নাগরিক কাজ করেন। অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশে কাজ করা বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা ও তাঁদের দেশে পাঠানো প্রবাসী আয়ের পরিমাণ আরও বেশি হবে। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিদেশি নাগরিকেরা কাজের অনুমতি বা ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই এ দেশে কাজ করেন। পাশাপাশি তাঁরা প্রবাসী আয় দেশে পাঠান অবৈধ পথে। গত ২০ জানুয়ারি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট ফারুক সোবহান বলেছিলেন, বাংলাদেশের শিল্প খাত ও ব্যবসা-বাণিজ্যে যেসব ভারতীয় নাগরিক কাজ করেন, তাঁরা বছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা ভারতে নিয়ে যান। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে আলাপের বরাত দিয়ে তিনি এ তথ্য জানান।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিদেশি নাগরিক কাজ করেন তৈরি পোশাক খাতে। কেন বিদেশিরা কাজ পান, জানতে চাইলে বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি ও পোশাক খাতের ব্যবসায়ী ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এর মূল কারণ দেশে কর্মমুখী শিক্ষা ও দক্ষতার ঘাটতি। শিল্পের যে চাহিদা, সে অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ানো হয় না। তিনি বলেন, ‘এ দেশের তরুণেরা সাধারণ শিক্ষার পেছনে দৌড়ায়। কিন্তু বেসরকারি খাতে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদের চাহিদা কম। ফলে উচ্চশিক্ষা লাভ করেও তরুণেরা চাকরি পাচ্ছে না, হতাশা বাড়ছে।’

কত বিদেশি কর্মরত

বাংলাদেশে কত বিদেশি নাগরিক কাজ করেন, তার একটি হিসাব ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদে দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তাঁর দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, এ দেশে ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন বিদেশি নাগরিক কাজ করেন, তাঁদের অর্ধেকই ভারতীয়। ভারতীয়দের সংখ্যা ৩৫ হাজার ৩৮৬ জন এবং চীনা ১৩ হাজার ২৬৮ জন। এরপর রয়েছে জাপান—৪ হাজার ৯৩ জন। এ ছাড়া কোরিয়ার ৪ হাজার ৯৩ জন, মালয়েশিয়ার ৩ হাজার ৩৯৫ জন ও শ্রীলঙ্কার ৩ হাজার ৭৭ জন নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করেন। থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, সিঙ্গাপুর ও তুরস্কের নাগরিকেরাও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে কর্মরত।

অবশ্য অভিযোগ আছে, প্রচুরসংখ্যক বিদেশি নাগরিক পর্যটক ভিসায় বাংলাদেশে এসে কাজ করেন। তাঁরা কখনো আনুষ্ঠানিক হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হন না। বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডের হিসাবে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে সাড়ে সাত লাখ বিদেশি নাগরিক এসেছেন।

বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে শ্রীলঙ্কায় উল্লেখযোগ্য কোনো প্রবাসী আয় যায় না। কিন্তু এ দেশে পোশাক খাতে শ্রীলঙ্কার অনেক নাগরিক কাজ করেন।

দেশে বিদেশি নাগরিকদের কাজের অনুমতি দেয় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) ও এনজিওবিষয়ক ব্যুরো। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই অনুমতি নেওয়া হয় বিডার কাছ থেকে। সংস্থাটি জানাচ্ছে, ২০১৭ সালে ৩ হাজার ১৭১ জন বিদেশি নাগরিককে কাজের অনুমতি দিয়েছে। অন্যদিকে নবায়ন করা হয়েছে ৪ হাজার ১১৩ জনের। বেপজা জানিয়েছে, এখন রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোতে আড়াই হাজারের মতো বিদেশি নাগরিক কাজ করেন। বিদেশিদের বেতন বাংলাদেশিদের চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ বেশি।

ঘাটতি মধ্যম পর্যায়ে

বাংলাদেশে বিদেশিরা সাধারণত কোন ধরনের পদে কাজ করেন, তা জানতে গত এক মাসে বড় বড় অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা জানায়, বিদেশিরা মূলত কাজ করেন কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থাপনা, যন্ত্রপাতি পরিচালনা, মাননিয়ন্ত্রণ ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপনায়। পোশাক খাতের মার্চেন্ডাইজিং ও বায়িং হাউসেও অনেক বিদেশি কাজ করেন।

বেপজা জানায়, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোতে কারিগরি ও পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার উচ্চপদগুলোতে বিদেশিরা কাজ করেন। পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালক পদেও বিদেশি নাগরিকদের নিয়োগ দেওয়া হয়।

জানতে চাইলে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলা প্রথম আলোকে বলেন, দেশের উচ্চশিক্ষিতদের ইংরেজি জ্ঞানের অভাব রয়েছে। তাঁরা হাতে-কলমেও কিছু শেখেন না। তিনি নিজের কারখানায় ওয়েল্ডিং সুপারভাইজার নিয়োগের একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘ওয়েল্ডিং সুপারভাইজার পদে আগ্রহী একজন প্রকৌশলী জানেন না কীভাবে ওয়েল্ডিং করতে হয়। তাঁকে হাতে-কলমে এ শিক্ষা দেওয়া হয়নি। আমি নিজে কিন্তু হাতেকলমে ওয়েল্ডিং শিখেছি।’

সাধারণ পদে প্রার্থী বেশি, কারিগরিতে কম

দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপে প্রায় প্রতি মাসেই কর্মী নিয়োগ হয়। সেখানে সাধারণ শিক্ষার পদ ও কারিগরি পদগুলোতে প্রার্থী সংখ্যায় অনেক বেশি পার্থক্য হয় বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদের সংখ্যা বেশি। কারিগরি দিক দিয়ে দক্ষ লোক তৈরি কম হচ্ছে।’

দেশের শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ সাধারণ শিক্ষায় পড়াশোনা করেন। কারিগরি বিষয়ে তাঁদের আগ্রহ কম। কারিগরির মধ্যে আবার উচ্চশিক্ষায় মেধাবীদের আগ্রহ বেশি। কিন্তু উদ্যোক্তারা বলছেন, বাংলাদেশে দক্ষ লোক দরকার মধ্যম পর্যায়ে। সেখানে মেধাবীদের যাওয়ার হার কম। উদ্যোক্তারা মনে করেন, দেশে এখন উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর সাধারণ বিষয়ে উচ্চশিক্ষা সীমিত করা দরকার। বিপরীতে কারিগরি শিক্ষার দিকে ঝোঁক তৈরি করতে হবে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, জার্মানির মতো দেশগুলো তাদের শিল্পের কী চাহিদা, সে অনুযায়ী জনশক্তি তৈরি করে। বাংলাদেশেও সেটা দরকার।