বাংলাদেশে মিশে যাওয়া বহুজাতিক

এই বদ্বীপে যাত্রা শুরু ৫৫ বছর আগে। বাংলাদেশের প্রতি ১০টি পরিবারের সাড়ে ৯টিতে কেনা হয় প্রতিষ্ঠানটির পণ্য। মুনাফার ৪০ শতাংশ পায় বাংলাদেশ সরকার। বৈশ্বিকভাবে ১৯০টি দেশের মধ্যে মুনাফার হারের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান সেরা পাঁচে। এই গল্প ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের।

ইউনিলিভার প্রায় ২০ হাজার কর্মীর পরিবার। ২০১৯ সালের শেষ দিকে কর্মীদের নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক আয়োজন ‘বিজনেস ডে’ শেষে একাংশ দাঁড়িয়ে তৈরি করে ফেলেন ইউনিলিভারের লোগো। সিলেটের একটি রিসোর্টে।ছবি: ইউনিলিভারের সৌজন্যে

চুল ধোয়ার জন্য যে শ্যাম্পু ব্যবহার করা যায়, তা বাংলাদেশের সীমিত আয়ের মানুষ শিখেছিল এক টাকার মিনিপ্যাকের হাত ধরে। বিপণনের এ কৌশলটি দেশের নিত্যব্যবহার্য ও ভোগ্যপণ্যের বাজারে (এফএমসিজি) বিপ্লব এনেছিল। শ্যাম্পুর মতো শৌখিন পণ্য পৌঁছে দিয়েছিল দেশের সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে।

বিপণনের কৌশলটি শুরুতে নিয়েছিল ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড (ইউবিএল)। তারা ২০০৩ সালে প্রথম শ্যাম্পুর ব্র্যান্ড ক্লিনিকের এক টাকার মিনিপ্যাক বাজারে ছাড়ে। এরপর ছাড়া হয় সানসিল্কের মিনিপ্যাক।

কৌশলটি বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও মিনিপ্যাকে পণ্য বাজারে ছাড়ে। শুধু শ্যাম্পু নয়, এখন মোটামুটি সব নিত্যপ্রয়োজনীয় ও ভোগ্যপণ্যই ছোট ছোট মোড়কে বাজারজাত করে কোম্পানিগুলো।

আজকে পোশাক কারখানায় বেতন না হলে এফএমসিজি খাতের করপোরেটের প্রধান নির্বাহীর (সিইও) কপালে ভাঁজ পড়ে। গ্রামে বন্যা হলে দুশ্চিন্তায় পড়ে বিপণন বিভাগ। এর কারণ বড় করপোরেটের বাজার দেশের তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে মিনিপ্যাকের।

বাংলাদেশে ৫৫ বছরের যাত্রায় এভাবে নতুন নতুন পণ্য ও উদ্ভাবনী বিপণন কৌশল নিয়ে এসেছে ইউনিলিভার। প্রতিষ্ঠানটি ব্রিটিশ ও ডাচ বহুজাতিক। অবশ্য বাংলাদেশে এটিতে কাজ করেন বাংলাদেশিরাই। ২০ হাজার কর্মীর মাত্র ৬ জন বিদেশি। বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে ১১ জন বিভিন্ন দেশে ইউনিলিভারে কাজ করেন। কোম্পানিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের ৪০ শতাংশ মালিকানা রয়েছে। ইউনিলিভারের মুনাফার ভাগ নিয়মিতই পায় সরকার।

বাজার জরিপকারী বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান নিয়েলসেনের জরিপ বলছে, বাংলাদেশে ইউনিলিভারের বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ ৯ হাজার কোটি টাকার মতো। এফএমসিজির বাজারে তাদের হিস্যা ৫৩ শতাংশের মতো। দেশের প্রতি ১০টি পরিবারের সাড়ে ৯টিতে ব্যবহৃত হয় ইউনিলিভারের পণ্য।

কেদার লেলে, ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
ছবি: তানভীর আহম্মেদ

ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেদার লেলে মনে করেন, ইউনিলিভার বাংলাদেশের মাটিতে মিশে যাওয়া একটি বহুজাতিক। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ আমাদের ব্র্যান্ডকে ভালোবেসেছে। আমরাও বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞ। আসলে আমরা নিজেদের বহুজাতিক ভাবি না, মনে করি এ দেশের আর পাঁচটি কোম্পানির মতোই।’

এই মনে করার কারণ কী কী, তা–ও ব্যাখ্যা করেন কেদার লেলে। তাঁর মতে, মানুষ মনে করে বহুজাতিকেরা একটি দেশে এসে শুধু টাকা কামাই করে চলে যায়। মুনাফা শব্দটিও বাংলায় ইতিবাচক নয়। কিন্তু ইউনিলিভার এ দেশে এসেছে স্বাধীনতার আগে। আরও বহু বছর থাকতে চায়। সে লক্ষ্য নিয়ে নিয়মিত বিনিয়োগ করছে। দেশের সেরা করদাতা প্রতিষ্ঠানের একটি ইউনিলিভার। তাদের মুনাফার ভাগও সরকারের মাধ্যমে এ দেশের মানুষ পাচ্ছে। আর্থসামাজিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে ইউনিলিভার।
কেদার লেলে বলেন, ‘একটি দেশে আপনি শুধু মুনাফা করে টিকে থাকতে পারবেন না। সমাজের সঙ্গে মিশে যেতে হবে, সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে হবে। মানুষের ভালোবাসা পেতে হবে।’

যা–ই হোক, ইউনিলিভারের প্রতিষ্ঠা কিন্তু বাংলাদেশ থেকে অন্তত আট হাজার কিলোমিটার দূরে, যুক্তরাজ্যে। গুগল বলছে, উড়োহাজাজে ১৪ ঘণ্টার যাত্রা। রানি ভিক্টোরিয়ার রাজত্বকালে ১৮৮৫ সালে উইলিয়াম হেসকেথ লিভার সানলাইট ব্র্যান্ডের সাবান বাজারে আনেন। প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল লিভার ব্রাদার্স। উইলিয়ামের বাবা ছিলেন এক মুদিদোকানি। সেখানে কাজ করেছেন উইলিয়ামও।

সানলাইট সাবান বাজার মাত করেছিল। শুধু যুক্তরাজ্যে নয়, বৈশ্বিক সাবান বাণিজ্যের একটা হিস্যা দখল করে ফেলে সানলাইট। ১৯১৭ সালে কোম্পানিটি পণ্যে বৈচিত্র্য আনা শুরু করে। ১৯৩০ সালে লিভার ব্রাদার্স নেদারল্যান্ডসের খাদ্য খাতের কোম্পানি মার্জারিন ইউনির সঙ্গে একীভূত হয়, নাম হয় ইউনিলিভার।

ইউনিলিভারে সাধারণ নিয়োগ সারা বছর চলতেই থাকে। তবে ‘ফিউচার লিডার’ নামে কর্মসূচির আওতায় তারা সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সেরাদের নিয়োগ দেয়।

এখন ইউনিলিভার ১৯০টি দেশে ব্যবসা করে। বিশ্বজুড়ে তাদের ৪০০টির বেশি ব্র্যান্ড রয়েছে। এফএমসিজি খাতে ৪৪টি দেশে তারা ১ নম্বর নিয়োগকারী। ইউনিলিভারের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে তাদের মোট পণ্য বিক্রির পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ১৯৮ কোটি ইউরো, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫ লাখ কোটি টাকার বেশি।

এখন বাংলাদেশ ইউনিলিভারের কারখানার সংখ্যা সাতটি।

বাংলাদেশে ইউনিলিভার


উপমহাদেশে প্রথম ইউনিলিভারের পণ্য আসে ১৮৮৮ সালে। ওই বছর কলকাতা বন্দরে লিভার ব্রাদার্সের পণ্যের একটি চালান পৌঁছায়। লেখা ছিল, ‘মেড ইন ইংল্যান্ড বাই লিভার ব্রাদার্স’। ১৯৩৩ সালে ভারতের মুম্বাইয়ে লিভার ব্রাদার্সের প্রথম কারখানা চালু হয়। পরে আরেকটি কারখানা তারা কলকাতায় করে। ১৯৪৮ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে কারখানা করে লিভার ব্রাদার্স।


বাংলাদেশে (তখনকার পূর্ব পাকিস্তান) চট্টগ্রামের কালুরঘাটে লিভার ব্রাদার্সের কারখানা চালু হয় ১৯৬৪ সালে। সেটি ছিল সাবানের কারখানা। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ৫ জুলাই লিভার ব্রাদার্স বাংলাদেশ নামে যাত্রা শুরু করে। ২০০৪ সালে লিভার ব্রাদার্স ইউনিলিভার নামে যাত্রা শুরু করে।


এখন বাংলাদেশ ইউনিলিভারের কারখানার সংখ্যা সাতটি। একটি তাদের নিজস্ব, বাকি ছয়টিতে তারা চুক্তির ভিত্তিতে পণ্য উৎপাদন করে। বাজারে তাদের সেরা ব্র্যান্ড সাবানে লাক্স, লাইফবয়, হুইল ও ডিটারজেন্টে সার্ফ এক্সেল, শ্যাম্পুর ব্র্যান্ড সানসিল্ক, প্রসাধন ব্র্যান্ড পন্ডস ও ভ্যাসলিন, চায়ের ব্র্যান্ড তাজা এবং পানি পরিশোধনের যন্ত্র পিউরিট। রয়েছে আরও অনেক ব্র্যান্ড।

আগে জীবন, তারপর জীবিকা

করোনাকালে ইউনিলিভারের ব্যবসা কেমন গেল, কী কী কৌশল নিয়ে তারা এগিয়েছিল, এখন পরিস্থিতি কী—এসব জানতে গত সোমবার (৭ সেপ্টেম্বর) গিয়েছিলাম প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেদার লেলের বাসায়। কেদার তিন বছর আগে বাংলাদেশে আসেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন, গত মাসের শেষে চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পেয়েছেন।


কেদার দুই সন্তান, স্ত্রীসহ রাজধানীর গুলশানে থাকেন। সময় দিয়েছিলেন সকাল পৌনে নয়টায়। ফটোসাংবাদিকসহ গিয়ে দেখা গেল, কেদারের স্ত্রী শ্বেতা সহস্রবুদ্ধে আমাদের জন্য সকালের খাবার সাজিয়ে বসেছেন। মূল পদ ইদলি, সঙ্গে আরও অনেক কিছু।
কেদার লেলে ও তাঁর স্ত্রী মারাঠি। শ্বেতা নিরামিষভোজী। কেদার ঘরে নিরামিষ খেয়েই থাকেন, বাইরে আমিষে তাঁর আপত্তি নেই। ইলিশ মাছ বিশেষ পছন্দ। কয়েক দিন আগেই মাওয়া ঘাটে গিয়ে পদ্মা নদীতে নৌকায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। মাঝনদীতে গিয়ে ঢাউস আকারের ইলিশ কিনে এনেছেন। তবে স্ত্রী তা ধরতেও নারাজ।

কেদার লেলে, ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
ছবি: তানভীর আহম্মেদ

আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার ৫৫ মিনিটের। এর মধ্যে কেদার ব্যবসা নিয়ে অনেক কথাই বললেন। বাংলাদেশের সম্ভাবনার দিক, সমস্যাও উঠে এল। বলেন, ‘করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে বাংলাদেশে সাধারণ ছুটি শুরুর পর আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার ছিল জীবন, তারপর জীবিকা। আমরা ঠিক করেছিলাম, কর্মীদের যত্ন নেব। কর্মীরা ব্যবসার যত্ন নেবে।’


ইউনিলিভার ধরেই নিয়েছিল, তাদের কিছু পণ্যের বিক্রি কমবে। আবার কিছু বাড়বে। তারা প্রথম জোর দিয়েছিল কারখানা চালু রাখার দিকে। কেদার বলেন, করোনা প্রতিরোধে বাংলাদেশের মানুষের প্রথম দরকার ছিল সাবান। এ জন্য সরবরাহ ঠিক রাখা জরুরি ছিল। বাজারে সাবান থাকবে না, এটা ঠিক নয়।


করোনার মধ্যে ইউনিলিভারের কারখানা এক দিনও বন্ধ ছিল না। তবে বৈশ্বিকভাবে তারা যেসব সুরক্ষাব্যবস্থা নেয়, সেই সব সুরক্ষা নিয়ে কারখানা চালু রাখে। অফিস অবশ্য বাসা থেকে, যা বলা হয় ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’। সেটা এখনো চলছে। করোনার শুরুর দিকেও ইউনিলিভারের ১৫ হাজার কর্মী মাঠে ছিলেন।

বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় পর্যায়ের কর্মীরা দারুণ কাজ করেছে। সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক লেনদেন সহজ করেছিল, যা সব ব্যবসাকে দারুণ সহায়তা করে।

পণ্যের চাহিদা কীভাবে সামাল দেওয়া গেছে, তা–ও জানান কেদার লেলে। বলেন, তাঁদের কাছে চার থেকে ছয় সপ্তাহের পণ্য সব সময় থাকে। থাকে আরও ছয় সপ্তাহের কাঁচামাল। বাজারে যেহেতু চাহিদা কম ছিল, বেশি সময় চালানো গেছে।
একটা সময় পর বন্দর চালু হলো। ভারত ও বাংলাদেশের রেলওয়েকে রাজি করিয়ে ট্রেনে পণ্য আনার ব্যবস্থা করতে পারল ইউনিলিভার। কেদার লেলে বলেন, বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় পর্যায়ের কর্মীরা দারুণ কাজ করেছে। সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক লেনদেন সহজ করেছিল, যা সব ব্যবসাকে দারুণ সহায়তা করে।

নেদারল্যান্ডসে ইউনিলিভারের হেডকোয়ার্টার।

বাজার ঘুরছে

সংকট মোকাবিলায় ইউনিলিভার পাঁচটি মূল ভিত্তি নিয়ে এগিয়েছে। ১. মানুষকে সুরক্ষা দেওয়া। ২. পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখা। ৩. চাহিদার বিষয়ে ধারণা রাখা। ৪. কোম্পানিতে নগদ অর্থের ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখা। ৫. মানুষ ও সমাজকে সহায়তা করা।
কেদার লেলে বলেন, সংকটকালে মানুষের হাতে টাকা কম ছিল। কারণ ৮০ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। তাদের মাস শেষে বেতনের নিশ্চয়তা নেই। ফলে চাহিদা কমে যায়। আগস্টে বন্যা ও বৃষ্টির কারণে বাজারে প্রভাব পড়েছে। দুই ঈদেও বিক্রি ২৫ শতাংশ কম হয়েছে। সব মিলিয়ে বিক্রি কিছুটা কমেছিল ইউনিলিভারের।


অবশ্য এখন বাজার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কেদার লেলে বলেন, ‘সেপ্টেম্বরে আমরা ভালো ব্যবসার আশা রাখি। শীতে আরও ভালো হবে। বছরের শেষ নাগাদ ব্যবসা স্বাভাবিক পর্যায়ে আসার আশা করছি।’

কীভাবে, তার ব্যাখ্যাও দেন কেদার লেলে। বলেন, পোশাক খাত ভালো করছে। মানুষ কাজ পাচ্ছে। বোরো মৌসুমে ভালো ফলন হয়েছে। চাষিরা দামও ভালো পেয়েছেন। ওদিকে শীত এলে প্রসাধনের চাহিদা বাড়বে।


বাংলাদেশের অর্থনীতি কত দিনে আগের গতিতে যেতে পারবে, একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কেদার লেলের কাছে এ প্রশ্ন জানতে চেয়েছিলাম। তাঁর মত হলো, সামগ্রিকভাবে বছর দুই লাগতে পারে। দেড় বছরের আগে ভ্যাকসিন আসবে না। ভ্যাকসিন না এলে মানুষের জীবনযাত্রা পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়তো হবে না।

‘বড় পরিকল্পনা আছে’


কেদার লেলে বাংলা ভালো বোঝেন। বলতে পারেন। এমনকি বাংলা যুক্তাক্ষরও পড়তে পারেন। পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে কাজ করার সময় ওপাশ থেকে বাংলাদেশকে দেখেছেন। এ দেশে এসে রীতিমতো শিক্ষক নিয়োগ করে বাংলা শিখেছেন।
বাংলাদেশে ইউনিলিভারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, জানতে চাইলে কেদার লেলে বাংলায় বলেন, বড় পরিকল্পনা আছে। কী কী তা পুরোপুরি খোলাসা করেননি। তবে জানালেন, তারা দুই হাজার কোটি টাকায় গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন (জিএসকে) বাংলাদেশের পুষ্টি পণ্যের ব্যবসা কিনেছেন। যার মূল ব্র্যান্ড হরলিকস। তিনি বলেন, জিএসকে ওষুধ কোম্পানি। পুষ্টি পণ্যের ব্যবসাটি এত দিন ভুল জায়গায় ছিল। হরলিকসের জন্য ভালো জায়গা হবে ইউনিলিভার।

বাংলাদেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ সাবান ব্যবহার করে, ৯৭ শতাংশ শ্যাম্পু ব্যবহার করে, ৭০ শতাংশ টুথপেস্ট ও ৩০ শতাংশ টুথ পাউডার ব্যবহার করে—হরলিকসে সে হার ১৫ শতাংশ। এসব তথ্য জানিয়ে কেদার বলেন, এর মানে হলো, হরলিকসের ব্যবসা বাড়ানোর অনেক সুযোগ রয়েছে।

সিইওর কারখানা

ইউনিলিভার শুধু সাবান, শ্যাম্পু উৎপাদন করে না, প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসার নেতৃত্বও গড়ে তোলার কারখানা। বাংলাদেশে দেশীয় যেসব করপোরেট রয়েছে, তার অনেকগুলোর সিইওর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল ইউনিলিভার দিয়ে। কেদার লেলে বলেন, ইউনিলিভার নেতৃত্ব তৈরি করে।


ইউনিলিভারে সাধারণ নিয়োগ সারা বছর চলতেই থাকে। তবে ‘ফিউচার লিডার’ নামে কর্মসূচির আওতায় তারা সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সেরাদের নিয়োগ দেয়। যেকোনো অনুষদে পড়াশোনা করে সেখানে কাজ করা যায়।


নিয়োগ পেতে মেধা, দৃষ্টিভঙ্গি, সততা ও শেখার মনোভাব থাকতে হবে জানিয়ে কেদার লেলে বলেন, ব্যবসা জটিল কিছু নয়, সাধারণ জ্ঞান।

কেদার লেলে, ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
ছবি: তানভীর আহম্মেদ

বাংলাদেশের সময় এসে গেছে
—কেদার লেলে, চেয়ারম্যান, ইউনিলিভার বাংলাদেশ

ইন্ডিয়ান স্কুল অব বিজনেস (আইএসবি) থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে তিনটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন কেদার লেলে। ২০০৪ সালে যোগ দেন হিন্দুস্তান ইউনিলিভারে, পদ বিক্রয় ব্যবস্থাপক। ২০১৭ সালের জুনে প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন ইউনিলিভার বাংলাদেশে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন ২০১৮ সালে। চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন গত মাসে।


আমি বাংলাদেশের প্রেমে পড়ে গেছি। টিকে থাকার সত্যিকার সক্ষমতা কী, তা বাংলাদেশে না এলে জানতে পারতাম না। আমি দেখেছি, বন্যার মধ্যেও বাংলাদেশের মানুষ কীভাবে জীবন সচল রাখে। পরিবেশকের দোকানে দুই ফুট পানি, তার মধ্যে পণ্য সরবরাহ চলছে। এ দেশের মানুষ খুবই আতিথেয়তাপ্রবণ। খাওয়াতে ভালোবাসে, খেতে ভালোবাসে।


বাংলাদেশের সময় এসে গেছে। দেশটি হলো প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বিশ্বের ‘লাস্ট ফ্রন্টিয়ার’, যেখানে ১৬ কোটি মানুষ আছে। এর মানে হলো, ফলে যেকোনো কোম্পানির জন্য বাংলাদেশ ব্যবসার বড় জায়গা হবে। এ দেশ সৃষ্টিশীলতার জন্য বিখ্যাত। বাংলাদেশের মানুষের শিল্পকলা, নকশা করা, পণ্য উৎপাদনের ক্ষমতা অন্যদের চেয়ে এগিয়ে। আপনি পোশাক খাত দেখুন, শাড়ি দেখুন—কী নিপুণ হাতে এগুলো তৈরি হয়।

বিশ্বের ১৯০টি দেশে কাজ করে ইউনিলিভার। এ ক্ষেত্রে ব্যবসার আকারের দিক দিয়ে বাংলাদেশ মোটামুটি ৩৬ অথবা ৩৭ নম্বর। তবে প্রফিটিবিলিটি বা মুনাফার হারের দিক দিয়ে বাংলাদেশ সেরা পাঁচে থাকবে। যদিও আমরা তালিকা করি না। এর কারণ হলো, বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। দুই বর্গকিলোমিটারের ভেতরে এক হাজার দোকান পাওয়া যায়। এর ফলে কম খরচে বেশি পণ্য বিক্রি করা যায়।

তবে সমস্যা হলো বাংলাদেশ সম্পর্কে বৈশ্বিকভাবে ধারণা ইতিবাচক নয়। সবাইকে ভাবমূর্তি উন্নয়নে কাজ করতে হবে, সে ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও কাজ করবে। বিনিয়োগ টানতে হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ও মুনাফা ফেরত নেওয়া সহজ করতে হবে। একজন বিনিয়োগকারী যদি এখনই নিশ্চিত হন যে পাঁচ বছর পরে তিনি অর্থ সহজে ফেরত নিতে পারবেন, তাহলে বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন।


আরেকটি বিষয় হলো, নীতির ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। করকে সহজ করুণ এবং মধ্যমেয়াদি একটি কাঠামো করুন। জুন মাসে সবাইকে কেন বাজেটের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। বাজেটের অপেক্ষায় ছয় মাস কোনো বিনিয়োগ হয় না। যেমন গত বাজেটে ‘প্রমোশনাল’ ব্যয়ের সীমা বেঁধে দেওয়া হলো। এটা নিয়ে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন।
লাইফবয় ক্রিকেট টিমের পৃষ্ঠপোষক (স্পনসর) হয়, তখন অনেকেই বলেছে, আমরা কাজটি করছি। আমরা বলেছি, বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জয় থেকে দুই ধাপ পেছনে রয়েছে। শিগগিরই বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিতবে। এ দেশের পোশাক, ওষুধ—আরও অনেক খাত এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ খুবই সম্ভাবনাময়।


এ দেশে যখন একজন বিদেশিকে পাঠানো হয়, তখন তিনি কাঁদেন। আবার ফেরত যাওয়ার সময় কাঁদেন। আসার সময় আসতে চান না, যাওয়ার সময় যেতে চান না। এ দেশকে ভালোবেসে ফেলেন।