বাবুবাজারে চালের ব্যবসায় ভাটা

পুরান ঢাকার বাবুবাজারে একটি আড়তে চালের নমুনা সাজিয়ে রাখছেন বিক্রেতারা। ছবিটি গতকাল তোলা l প্রথম আলো
পুরান ঢাকার বাবুবাজারে একটি আড়তে চালের নমুনা সাজিয়ে রাখছেন বিক্রেতারা। ছবিটি গতকাল তোলা l প্রথম আলো

মনজুর রহমান। বাদামতলীর খাদিজা রাইস এজেন্সির হিসাবরক্ষক। দোকানের গদিতে বসে আছেন। সামনে প্লাস্টিকের বাটিতে বিভিন্ন রকম চালের নমুনা। পেছনে সারি সারি চালের বস্তার স্তূপ। কেমন চলছে ব্যবসা? রাখঢাক না করেই এ তরুণ বললেন, ‘দুই-আড়াই বছর আগে দিনে ১২০ বস্তা চাল বিক্রি হতো। এখন ৭০-৮০ বস্তার বেশি হয় না। ঢাকার বাইরের পাইকারেরা আসেন না। চাহিদা কমে গেছে।’
পুরান ঢাকার বাদামতলী ও বাবুবাজারের চালের পাইকারি আড়তে গতকাল বুধবার মনজুরসহ বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানালেন, ব্যবসায় ভাটার টান পড়েছে। একসময় ঢাকার পাশাপাশি বিভিন্ন জেলার পাইকারদের কাছে চালের জন্য বাবুবাজার ও বাদামতলীর আড়তই ছিল প্রথম পছন্দ। তবে কয়েক বছর ধরে চালকল মালিকদের প্রতিনিধিরাই জেলায় জেলায় পাইকারদের চাল পৌঁছে দিচ্ছেন। অন্যদিকে ঢাকার মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, মালিবাগ, কচুক্ষেতে গড়ে উঠেছে চালের পাইকারি বাজার। ফলে এই পাইকারি আড়তে ব্যবসায়ীদের আনাগোনা কমে এসেছে। অনেকে আবার যানজটের কারণেও নিরুৎসাহিত হয়েছেন।
বাদামতলী-বাবুবাজার চাল আড়ত মালিক সমিতির নেতারা জানান, কয়েক বছর আগে এখানে ৩০০ আড়ত থাকলেও এখন আছে ১৮০ থেকে ১৯০টি। চালকলের মালিকের কমিশন এজেন্ট হিসেবেই ব্যবসা করেন অধিকাংশ আড়তদার। এ ক্ষেত্রে গাড়িভাড়া ও শ্রমিকদের মজুরি দেন চালকলের মালিকই। সেদ্ধ চালের প্রতি কেজিতে চালকলের কাছ থেকে ২৫ পয়সা এবং যে পাইকার কিনবেন, তাঁর কাছ থেকে ২৫ পয়সা হিসেবে মোট ৫০ পয়সা কমিশন পান আড়তদার। চিনিগুঁড়া চালে ৩৫ পয়সা করে ৭০ পয়সা কমিশন। অনেক ক্ষেত্রে আড়তদারদের একটি নির্দিষ্ট মূল্য ধরে চাল দেন চালকলের মালিকেরা। এই চালের কেজি বেশি দরে বিক্রি করতে পারলে লাভ, আর না পারলে লোকসানের মুখে পড়েন আড়তদারেরা।
পুরান ঢাকার নয়াবাজার থেকে দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচের সড়ক ধরে এগোতেই বাবুবাজার। সড়কের বাঁ পাশে সারি সারি চালের আড়ত। কয়েকটি আড়তে শ্রমিকদের ব্যস্ততা চোখে পড়ল, চালের বস্তা কাঁধে করে তুলে দিচ্ছেন ভ্যানগাড়ী কিংবা পিকআপ ভ্যানে। প্রতি বস্তায় তাঁদের মজুরি পাঁচ টাকা।
শাহজালাল রাইস এজেন্সির কর্মকর্তা এমদাদ হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। লাল মলাটের খাতায় হিসাব কষতে কষতে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘এখানে হইছে বাকির খেলা। যারা বাকিতে মাল দিতে পারেন, তাঁদেরই ব্যবসা আছে।’ যানজট নিয়ে ক্ষোভ জানালেন, ‘বাবুবাজারে আসা-যাওয়ার যতগুলো পয়েন্ট আছে, সবখানেই কঠিন জ্যাম। ক্রেতা কেমনে আইব, আপনিই বলেন।’
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নয়াবাজারে যানজট ঠেলে আসার সময়ই এমদাদের কথার সত্যতা কিছুটা পাওয়া গেছে। তবে বাবুবাজার মূল সকড়টি এখন মুটোমুটি ফাঁকাই, কিছুদিন আগেই সেতুর নিচের অবৈধ স্থাপনা সরানো হয়েছে। অবশ্য বাদামতলীর দিকে যেতেই ভয়াবহ চিত্র দেখা গেল। চালের পাশাপাশি এখানে ফলের বড় আড়ত। ফল নিয়ে আসা পাঁচ ছয়টি কাভার্ড ভ্যান সড়ক দখল করে দাঁড়িয়ে আছে। তাই বাবুবাজার থেকে বাদামতলী হয়ে সদরঘাটে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।
তিন বন্ধু মিলে বছর পাঁচেক আগে গড়েছেন মেসার্স দেশ রাইস এজেন্সি। তাঁদের একজন গৌতম ঘোষ। বললেন, ‘ঢাকার বাইরের ক্রেতা প্রায় নাই। ঢাকার ভেতরেই অনেকগুলো বাজার হয়ে গেছে। ফলে পাঁচ বছর আগে যে ব্যবসা ছিল, সেটি অর্ধেকে নেমে গেছে। বুড়িগঙ্গার ওপারে কেরানীগঞ্জ, জিঞ্জিরা, কালীগঞ্জ ও মৌলভীবাজারসহ আশপাশের পাইকারেরাই এখন বেশি আসেন।’
জানতে চাইলে জনপ্রিয় রাইস এজেন্সির মালিক আবদুল করিম বলেন, ‘তিন-চার বছর ধরে চালকলের মালিকেরা নিজেদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে জেলায় জেলায় চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁদের বাবুবাজার ও বাদামতলীতে চাল পাঠানোর মতো গাড়িভাড়া, শ্রমিক খরচ ও কমিশন দিতে হয় না। মূলত এ জন্য এখানকার আড়তদারি ব্যবসা একটি গণ্ডির মধ্যে চলে গেছে।’
আড়ত মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন ও সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম জানালেন, বাস্তবিক কারণেই বাদামতলী ও বাবুবাজারের ব্যবসা আগের মতো নাই। সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে। এতে সুবিধা-অসুবিধা দুটিই হয়েছে। আড়তদার কিংবা পাইকারদের সিন্ডিকেট করার সুযোগ কমেছে। বাজার পুরোপুরি চালকল মালিকদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।
কিছুটা ভিন্নমত দিলেন বাংলাদেশ চাল ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি জাকির হোসেন রনি। তিনি বলেন, ব্যবসা সরে যাওয়ার জন্য স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ীর দায়ও আছে। তবে নিরাপত্তা নিশ্চিত ও যানজট সমস্যার সমাধান পুরোপুরি করা গেলে ভবিষ্যতে এখানকার আড়তদারি ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব।