বাসা-অফিসে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয় ‘আমার ল্যাব’

যুক্তরাষ্ট্রে কম্পিউটারবিজ্ঞানে পড়াশোনা শেষ করে সেখানকার বহুজাতিক সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের চাকরিতে যোগ দেন বাংলাদেশি তরুণ তাজীন শাদীদ। কাজ করতেন যোগাযোগ ও পণ্য উদ্ভাবন নিয়ে। পরে সেই চাকরি ছেড়ে দেশে এসে শুরু করেন স্বাস্থ্যসেবায় নতুন ব্যবসায় উদ্যোগ বা স্টার্টআপ ‘আমার ল্যাব’।

দেশে উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে সেখানকার নর্থ টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটারবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তাজীন শাদীদ। এরপর ২০০৫ সালে যোগ দেন সেখানকার বহুজাতিক সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটে। কাজ করতেন যোগাযোগ ও পণ্য উদ্ভাবন নিয়ে। কিন্তু ২০০৭ সালে তাঁর মায়ের শরীরে ঘাতকব্যাধি ক্যানসার ধরা পড়লে যুক্তরাষ্ট্রে থাকার চেয়ে দেশের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে কাজ করার প্রতিই তাঁর আগ্রহ বেড়ে যায়। সে অনুযায়ী পরের কয়েক বছর যুক্তরাষ্ট্রে থেকেই দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বেশ কিছু কাজ করেন।

পরবর্তীকালে আরও বিস্তৃতভাবে কাজ করতে চান তাজীন শাদীদ। তাই ২০১৬ সালে দেশে ফিরে আসেন। এক বছর পরে আরও দুই সহযোগীকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন দেশের স্বাস্থ্য খাতের প্রথম ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস বা স্টার্টআপ ‘আমার ল্যাব’।

সবার জন্য সুলভ মূল্যে সহজে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বলে জানান ‘আমার ল্যাব’-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী তাজীন শাদীদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতাল বা রোগনির্ণয় কেন্দ্রে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়েননি, এমন মানুষের সংখ্যা এ দেশে কমই আছে। কখনো দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে, কখনোবা যাতায়াতের ক্ষেত্রে পড়তে হয় ভোগান্তিতে। পরীক্ষা শেষে আবার রিপোর্টও সংগ্রহ করতে হয় একই প্রক্রিয়ায়। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি ছাড়াও সময়ের অপচয় যেমন হয়, তেমনি অতিরিক্ত অর্থও ব্যয় হয়। সাধারণ এ সমস্যার প্রযুক্তিগত সমাধান নিয়েই কাজ করছে ‘আমার ল্যাব’।

প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে বাসা কিংবা অফিস—যেকোনো স্থান থেকে পরীক্ষা করাতে পারছেন গ্রাহকেরা। আর তা করা যাচ্ছে পছন্দের পরীক্ষাকেন্দ্র (ডায়াগনস্টিক সেন্টার) থেকেই। প্রতিষ্ঠার চার বছরের মধ্যে অর্ধলক্ষের বেশি পরীক্ষা করিয়েছে এ প্রতিষ্ঠান। তবে এ পর্যায়ে আসার যাত্রাটা আর দশটা ডিজিটাল মার্কেটপ্লেসের মতো সহজ ছিল না বলে তাজীন শাদীদ উল্লেখ করেন।

তাজীন শাদীদ বলেন, সাধারণ যেকোনো ডেলিভারি দেওয়া হয় ঘরের দরজার বাইরে। কিন্তু ‘আমার ল্যাব’ সেবা দেয় ঘরের অভ্যন্তরে প্রবেশের পরে। তাই শুরুতে স্বাস্থ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করে গ্রাহককে আস্থায় নেওয়াটা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এরপর সংগৃহীত নমুনা আবার মান বজায় রেখে পরীক্ষাকেন্দ্র (ল্যাব) পর্যন্ত পৌঁছানোটাও চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠার চার বছরের ব্যবধানে এখন বিষয়টি একটি প্রতিষ্ঠিত উদ্যোগ।

মাইক্রোসফটে কাজ করার সময় ২০০৭ সালে তাজীন শাদীদের মায়ের শরীরে মরণব্যাধি ক্যানসার ধরা পড়ে। তিনি জানান, মায়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত নিয়ে কাজ করার আগ্রহ তৈরি হয় তাঁর। বিশেষ করে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষকে কীভাবে সহজে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবতে থাকেন। ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের এক বস্তিতে একটি ক্লিনিক দিয়ে যাত্রা শুরু করেন সেই উদ্যোগের। তবে যুক্তরাষ্ট্রে বসেই কার্যক্রম তদারক করতেন তিনি। এভাবে বেশ কয়েক বছর চলে যায়। দেশে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আরও বিস্তৃত পরিসরে কাজ করতে অবশেষে ২০১৬ সালের অক্টোবরে তিনি মাইক্রোসফটের চাকরি ছেড়ে দেশে ফিরে আসেন।

মোহাম্মদপুরের ক্লিনিক পরিচালনার সময়ে তাজীন শাদীদের পরিচয় ঘটে এক তরুণ উদ্যোক্তা চিকিৎসক ইশতিয়াক জাহিদের সঙ্গে। এরপর আরেক বন্ধু সাব্বির আমিনকে সঙ্গে নেন। তিনজন মিলে ২০১৭ সালে ‘আমার ল্যাব’ প্রতিষ্ঠা করেন। তাজীন শাদীদ বলেন, ‘আমাদের দেশে স্বাস্থ্যসেবার সবকিছু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হয়। এখনো একটা জরুরি টেস্টের জন্য হাসপাতালে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হয়। এরপর আবার রিপোর্ট আনতেও যেতে হয়। চিকিৎসা ও রোগের ইতিহাস সংরক্ষণ এবং পারিবারিক চিকিৎসকের ধারণাও একদমই কম। সবচেয়ে বেশি সংকট দেখলাম রোগনির্ণয়ের পরীক্ষার (ডায়াগনস্টিক টেস্ট) ক্ষেত্রে। তাই তিনজন মিলে এ সমস্যার কীভাবে সমাধান করা যায়, তা নিয়ে ভাবলাম। তখন ডিজিটাল উপায়ে স্বাস্থ্যসেবা দিতে ঢাকার রায়েরবাজারে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুললাম।’

তাজীন শাদীদ আরও বলেন, ‘কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, গ্রাহকেরা তাঁদের পছন্দের ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকেই পরীক্ষা করাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এরপরই এ খাতে অনলাইন মার্কেটপ্লেস প্রতিষ্ঠা করলাম। আমরা এখন দেশের স্বনামধন্য অধিকাংশ ল্যাবের সঙ্গে যুক্ত। আমাদের এই মার্কেটপ্লেস থেকে গ্রাহক প্রথমে তাঁদের পছন্দের ল্যাব থেকে পরীক্ষার নিবন্ধন করেন। এ ক্ষেত্রে আমরা ল্যাবের নির্ধারিত ডিসকাউন্ট মূল্যই নিয়ে থাকি। আমাদের প্রশিক্ষিত মেডিকেল টেকনোলজিস্ট গ্রাহকের বাসা বা অফিসে গিয়ে পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করে তা ল্যাবে পৌঁছে দেন। এরপর পরীক্ষার রিপোর্ট গ্রাহকের ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া হয়।’

যুক্তরাষ্ট্রফেরত এই নবীন উদ্যোক্তা বলেন, ‘আমরা নিজেদের এক গবেষণায় দেখলাম যে সাধারণ একটি টেস্ট করাতে ও পরীক্ষার রিপোর্ট আনতে যাতায়াত, লাইনে দাঁড়ানোসহ একজন লোকের ন্যূনতম পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগে। এর ওপর যাতায়াত খরচের বিষয় তো আছেই। এ কাজই আমরা সহজ করে দিচ্ছি মাত্র ২০০ টাকা সার্ভিস ফির বিনিময়ে। অর্থাৎ, “আমার ল্যাব”–এর সেবা নিতে এসে গ্রাহকদের কোনোভাবেই বেশি টাকা খরচের প্রয়োজন পড়ছে না। বরং গ্রাহকেরা যাতায়াতের ভোগান্তি থেকে রক্ষা পান এবং তাঁদের সময় ও খরচ বাঁচে। আমাদের মূল আয়টা আসে ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে, গ্রাহকদের কাছ থেকে না।’ তিনি বলেন, প্রথম দিকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল মানুষ এটা বুঝতে চাইত না। এখন অবস্থা অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বিশেষ করে করোনার মধ্যে এই সেবার বিষয়ে মানুষের ইতিবাচক মনোভাব বেড়েছে।

তাজীন শাদীদ বলেন, ‘রক্ত, প্রস্রাব, পায়খানাসহ যেকোনো প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করিয়ে দিই আমরা। এ ছাড়া ইসিজির মতো কিছু পরীক্ষা, যেগুলো বহনযোগ্য যন্ত্রের মাধ্যমে করা যায়, সেগুলোও করছি। ভবিষ্যতে ভ্রাম্যমাণ একটি ল্যাব করার ইচ্ছা আছে। এর মাধ্যমে এক্স-রে ও এমআরআই যন্ত্রের মতো বড় আকারের যন্ত্রও বহন করা সম্ভব। তবে এ জন্য বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। তবে ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সব ধরনের সেবা দেওয়ার পরিকল্পনা আছে আমাদের। পৃথক নমুনা পরীক্ষা ছাড়াও প্যাকেজ আকারেও স্বাস্থ্য পরীক্ষার সেবা দিচ্ছি আমরা। গত ৩ মাসে ২৬টি করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে এই সেবা দিয়েছি আমরা।’

তাজীন শাদীদ

প্রাথমিকভাবে তিন নবীন উদ্যোক্তা নিজেদের অর্থায়নে ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। যাত্রা শুরু হয় তিনজন কর্মী নিয়ে। এখন আমার ল্যাবে প্রায় অর্ধশত লোক নিয়মিত কাজ করছেন। বর্তমানে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে ‘আমার ল্যাব’-এ বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় চার কোটি টাকা। ঢাকার মিরপুর, বনানী, আদাবর ও চট্টগ্রামে চারটি কার্যালয় আছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে সাভারে কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। চলতি বছরে গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে কাজ শুরুর পরিকল্পনা আছে। বিনিয়োগের অর্থ তুলে এখনো সম্পূর্ণ লাভে যেতে না পারলেও প্রতি মাসে ৩২ লাখ টাকার মতো আয় হয় বলে তাজীন শাদীদ জানান।

এখন পর্যন্ত ১৫ হাজারের বেশি গ্রাহক ‘আমার ল্যাব’-এর মাধ্যমে প্রায় ৩৭ হাজারের বেশি পরীক্ষা করিয়েছেন। বর্তমানে প্রতি মাসে তিন থেকে চার হাজার সেবা নিচ্ছেন। আগামী বছরের মধ্যে আটটা বিভাগীয় শহরে এবং পর্যায়ক্রমে সব জেলা শহরে সেবা বিস্তৃত করার পরিকল্পনা আছে ‘আমার ল্যাব’-এর।

তরুণ উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে তাজীন শাদীদ বলেন, ‘লক্ষ্যটা অনেক বড় হওয়া উচিত। আমরা ফেল করতে খুব ভয় পাই। এটা উদ্যোক্তাজীবনের সঙ্গে একদমই যায় না। এটা মাথায় রেখেই ঝুঁকি নিতে হবে। শেখার আগ্রহটা থাকতে হবে। অন্যের ভুল থেকে শেখার প্রচুর সুযোগ আছে; যেমন অন্যরা যে ভুল করেছে, আমরা যেন তা না করি।’