বিপাকে সাড়ে ১০ হাজার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী

সাড়ে ১০ হাজার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেড ও পদমর্যাদা বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছিল সরকার। সেটা ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের আগে। কিন্তু নির্বাচনের পর আট মাস পার হলেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
গত ৩ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এই কর্মকর্তাদের গ্রেড ও পদমর্যাদা বৃদ্ধির সুপারিশ-সংবলিত চিঠি দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে।
কার্যকর না করায় মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিঅ্যান্ডএজি) এবং হিসাব মহানিয়ন্ত্রক (সিজিএ)-এ দুই কার্যালয়ের চার পদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পদমর্যাদা ও গ্রেড উন্নীতকরণ নিয়ে বিপাকে রয়েছেন। আবার দাবি পূরণ না হওয়ায় সম্প্রতি ‘কলমবিরতি’ করে সব সরকারি কর্মকর্তার জুন মাসের বেতন আটকে দিয়েছিলেন।এই চার পদের কর্মকর্তারা হলেন জুনিয়র অডিটর, অডিটর, সাব-অর্ডিনেট অ্যাকাউন্টস সার্ভিস (এসএএস) সুপারিনটেনডেন্ট এবং নিরীক্ষা ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা (এঅ্যান্ডএও)।
তবে ৮ জুলাই সিঅ্যান্ডএজি মাসুদ আহমেদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে কথা বলে আশ্বস্ত করে পরিস্থিতির সামাল দেন। মাসুদ আহমেদ গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দাবির যৌক্তিকতা রয়েছে এবং সুপারিশ বাস্তবায়িত হওয়ার দরকার।’ অবশ্য বিষয়টি একান্তই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বলে জানান তিনি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, অর্থ বিভাগের এই সুপারিশ আপাতত বাস্তবায়নযোগ্য নয়। এতে গোটা প্রশাসনযন্ত্রে জটিলতা শুরু হতে পারে।অর্থাৎ একই দাবি উঠতে পারে অন্য সব সরকারি দপ্তরেও। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মুখে অবশ্য বলছে বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী।
যোগাযোগ করলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব দিলরুবা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুপারিশ কার্যকরে কিছু প্রশ্নের জবাব ও ব্যাখ্যা চাওয়া হলেও তা পাওয়া যায়নি। জবাব পেলেই আবার বৈঠক হবে।’
এদিকে সুপারিশ বাস্তবায়নে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে উল্টো তাগিদ দিয়েছে অর্থ বিভাগ। গত ২৯ জুন এক চিঠিতে অর্থ বিভাগ বলেছে, দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও এ বিষয়ে এখনো সম্মতি পাওয়া যায়নি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, অর্থ বিভাগের সুপারিশ অতটা জোরালো নয়। অর্থ বিভাগের চিঠি বিশ্লেষণেও এই সত্যতা পাওয়া গেছে।
২০০০ সাল থেকেই দাবিগুলো উঠছে বলে জানা গেছে। বিভিন্ন আবেদনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নানের সুপারিশও রয়েছে। অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব জালাল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সুপারিশ পাঠিয়েছি, কার্যকরের দায়িত্ব এখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের।’ এর বাইরে কোনো কথা বলতে চাননি তিনি।
অডিটরের সমানস্কেলভুক্ত সাব-রেজিস্ট্রার ও উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা এখন প্রথম শ্রেণির এবং খাদ্য পরিদর্শক, মন্ত্রণালয়ের হিসাবরক্ষক, স্টেনোগ্রাফার, উচ্চমান সহকারী ও কানুনগো দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা। অডিটরদের চেয়ে নিম্ন স্কেলে থাকা সচিবালয়ের সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার, ডিপ্লোমা নার্স, ব্লক সুপারভাইজার, পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর, পরিসংখ্যান সহকারী, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকেরাও এখন দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা।
জানা গেছে, সুপারিশ পুরোপুরি বাস্তবায়নে ক্যাডার কর্মকর্তাদের সঙ্গে নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হতে

পারে। তবে অতিরিক্ত উপমহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক সামিয়া আলম জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এক চিঠি পাঠিয়ে এ আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন। কিন্তু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ না থাকায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সামিয়া আলমের মতামতের সঙ্গে একমত হতে পারেননি।
জুনিয়র অডিটর: সিঅ্যান্ডএজি ও সিজিএ কার্যালয়ে জুনিয়র অডিটর রয়েছেন মোট দুই হাজার ৬৬ জন। তৃতীয় শ্রেণির পদমর্যাদার এই জুনিয়র অডিটররা ১৬তম গ্রেডে ৪৭০০-৯৭৪৫ টাকা কাঠামোতে বেতন পান। তাঁদের দাবি ১৪তম গ্রেডে ৫২০০-১১২৩৫ টাকা।
অর্থ বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, জুনিয়র অডিটরদের জন্য করা এ সুপারিশটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেননি। দিলরুবা প্রথম আলোকে বলেন, ‘পদমর্যাদার বিষয় না থাকায় এ দাবি কার্যকরে তেমন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।’
অডিটর: সাড়ে ১০ হাজারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাঁচ হাজার ৭৩৮ জন রয়েছেন অডিটর। তৃতীয় শ্রেণির অডিটররা একাদশ গ্রেডে ৬৪০০-১৪২৫৫ টাকা কাঠামোতে বেতন পান। তাঁদের জন্য সুপারিশ দশম গ্রেডে ৮০০০-১৬৫৪০ টাকা এবং দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা।
গত ২৩ জুন অতিরিক্ত ডেপুটি মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মো. নাজমুল আলম জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে এক চিঠিতে জানান, সরকারের অন্য অনেক বিভাগে অডিটর পদের সমস্কেলভুক্ত বহু পদকে দ্বিতীয় শ্রেণি, এমনকি প্রথম শ্রেণিও করা হয়েছে। অথচ স্নাতক ডিিগ্রধারী অডিটর এখনো তৃতীয় শ্রেণির।
অডিটর পদে দুই বছর চাকরির পর তাঁরা এসএএস সুপার পদে পদোন্নতির জন্য পরীক্ষা দিতে পারেন। দুই পর্বের ১২০০ নম্বরের বিভাগীয় পরীক্ষা পাসের পর তাঁরা এসএএস (সাব-অর্ডিনেট অ্যাকাউন্টস সার্ভিস) সুপার হন।
এসএএস সুপার: এই পদে রয়েছেন এক হাজার ৬৮৩ জন। দ্বিতীয় শ্রেণির এই কর্মকর্তারা দশম গ্রেডে ৮০০০-১৬৫৪০ টাকা বেতন পান। তাঁদের জন্য সুপারিশ নবম গ্রেডে ১১০০০-২০৩৭০ টাকা ও প্রথম শ্রেণি।
বেশির ভাগ এএসএস সুপার অবশ্য বর্তমানেও ১১০০০-২০৩৭০ টাকা অনুযায়ী বেতন পাচ্ছেন। এর চেয়ে বেশি কাঠামোতেও (১২০০০-২১৬০০) বেতন পাচ্ছেন অনেকে। নতুন সুপারিশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের আর্থিক কোনো সংশ্লেষ থাকবে না।
১২-১৪ বছর চাকরির পর এঅ্যান্ডএও (নিরীক্ষা ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা) পদে পদোন্নতি পান এসএএস সুপাররা। তখন তাঁরা নন-ক্যাডার প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্ত হন। ৫০-৬০ শতাংশ কর্মকর্তা অবশ্য পদোন্নতি ছাড়াই অবসর নেন।
নিরীক্ষা ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা: এই পদে রয়েছেন এক হাজার ১০ জন। নবম গ্রেডে প্রথম শ্রেণির নন-ক্যাডার এই কর্মকর্তারা ১১০০০-২০৩৭০ টাকা কাঠামো অনুযায়ী বেতন পেলেও তাঁদের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে সপ্তম গ্রেড এবং ১৫০০০-২৬২০০ টাকা বেতন কাঠামো। পদমর্যাদা পরিবর্তনের কোনো সুপারিশ করা হয়নি। তাই এটি কার্যকরে সরকারের বাড়তি খরচ হবে না।
তবে এঅ্যান্ডএওদের গ্রেড উন্নীতকরণে তুমুল আপত্তি বিসিএস (নিরীক্ষা ও হিসাব) ক্যাডার কর্মকর্তাদের। সিঅ্যান্ডএজি কার্যালয়ে হলে সহকারী মহা হিসাবনিরীক্ষক (এএজি) এবং অডিট অধিদপ্তরে হলে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়ে ক্যাডার কর্মকর্তারা বর্তমানে বেতন পান নবম গ্রেডে ১১০০০-২০৩৭০ টাকা কাঠামোতে।