বিশ্বজুড়ে অতিধনীর সংখ্যা বাড়ছে

করোনা মহামারির মধ্যে অসমতা পৃথিবীর ইতিহাসে এখন শীর্ষবিন্দুতে। দেশে দেশে টিকার বণ্টন সেই বৈষম্যকে আরও প্রকট করেছে। আবার বিভিন্ন দেশেই মহামারিতে সংকুচিত হওয়া অর্থনীতির পুনরুত্থান হচ্ছে ইংরেজি ‘কে’ অক্ষরের মতো, অর্থাৎ গরিবেরা আরও তলিয়ে যাচ্ছে।

কে আকৃতির পুনরুদ্ধারের বৈশিষ্ট্য হলো, এতে অর্থনীতির নির্দিষ্ট কিছু খাত ঘুরে দাঁড়ালেও অন্যান্য খাত পিছিয়ে থাকে। অর্থাৎ কে বর্ণে যেমন দুটি বিপরীতমুখী রেখা দেখা যায়, এই আকৃতির পুনরুদ্ধারেও তেমনটা দেখা যায়। সাধারণত অর্থনৈতিক মন্দার সময় সব খাত ও জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হয়—পুনরুদ্ধারের সময়ও একই ধারা দেখা যায়। কখনো কোনো খাত বেশি আক্রান্ত হয় বা তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়ায়, তবে সামগ্রিকভাবে একধরনের সমতা দেখা যায়। কিন্তু কে আকৃতির পুনরুদ্ধারে তার ব্যত্যয় দেখা যায়।

সম্প্রতি নাইট ফ্র্যাংকের সম্পদ প্রতিবেদনে আবারও অসমতার প্রকট চিত্র ফুটে উঠেছে। মহামারির মধ্যে ২০২১ সালে বিশ্বে অতিধনী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থাৎ সে বছর বিশ্বে নতুন করে ৫২ হাজার অতিধনী তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ বেড়েছে উত্তর আমেরিকায়—১২ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে আফ্রিকায় সম্পদের পরিমাণ কমেছে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ।

স্নায়ুযুদ্ধের পর রাশিয়া এখন আর অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে তেমন বড় কেউ নয়। যদিও সম্প্রতি তারা ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে। অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে তারা এখন বিশ্বের একাদশ। অথচ সেই রাশিয়ায় গত এক বছরে অতিধনীর সংখ্যা বেড়েছে ১১ দশমিক ২ শতাংশ। অতিধনীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে তৃতীয় স্থানে আছে অস্ট্রেলিয়া—৯ দশমিক ৮ শতাংশ। আর মধ্যপ্রাচ্যে বেড়েছে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ, ইউরোপে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ ও এশিয়ায় বেড়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ।

সম্পদ প্রতিবেদন ২০২২-এর তথ্যানুযায়ী, দেশের হিসাবে অতিধনীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। দ্বিতীয় স্থানে আছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। দেশেটিতে অতিধনী বেড়েছে ১১ শতাংশ। গত বছর ভারতে শতকোটি ডলারের মালিকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪২, আবার সে বছরেই দেশটির ৮৪ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে।

প্রতিবেদনটিতে পূর্বাভাষ দেওয়া হয়েছে, ২০২৬ সালের মধ্যে বিশ্বে অতিধনীর সংখ্যা আরও ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। মানুষের মধ্যেও এই ক্রমবর্ধমান অসমতা নিয়ে অসন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছে। প্রতিকার হিসেবে মানুষ চায়, অতিধনীদের সম্পদে আরও উচ্চ হারে করারোপ করা হোক। শুধু তা–ই নয়, যেসব দেশে বা অঞ্চলে নিম্ন হারে কর দিয়ে বিনিয়োগ করা যায়, তাদের ওপর খড়্গহস্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে জরিপের অংশগ্রহণকারীরা।

মহামারি মোকাবিলায় ২০২০ সালের মার্চ মাসে বিশ্বের প্রায় সব দেশে লকডাউন জারি হয়। অর্থনৈতিক কার্যক্রম থেকে শুরু করে মানুষের চলাচল পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ স্থবির হয়ে পড়ে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনাভাইরাসকে চীনা ভাইরাস হিসেবে আখ্যা দেন। কোভিড ছোঁয়াচে রোগ হওয়ায় এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে এত সবকিছুর পরও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৫ শতাংশ অতিধনী নতুন দেশের পাসপোর্ট বা নতুন নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার পরিকল্পনা করছেন। এদের মধ্যে ৩৬ শতাংশ উন্নত জীবনের সন্ধানে নাগরিকত্বের আবেদন করবেন। এদিকে ২০২১ সালে বৈশ্বিক রপ্তানি রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে। আবাসন খাতে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগও বাড়ছে। এই বাস্তবতায় বলাই যায়, বিশ্বায়নের আবেদন ফুরায়নি, বরং আরও বেড়েছে।

মহামারির মধ্যে যখন কোটি কোটি মানুষের আয় কমেছে, তখন একই সঙ্গে ধনীদের বিলাস-ব্যসনও বেড়েছে। প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ২০২১ সালে বিশ্বের বিলাসবহুল আবাসনের মূল্য বেড়েছে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। ধনীদের বিলাসের নতুন অনুষঙ্গ হচ্ছে প্রমোদতরি। ২০২১ সালে মহামারির মধ্যে প্রমোদতরির কার্যাদেশ বেড়েছে ৬ শতাংশ।

ধনীদের কর ও পিকেটি

বিশ্বখ্যাত ফরাসি অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটির ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি বইয়ে মহামন্দা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী ৩০ বছর সম্পর্কে নতুন ভাবনার খোরাক রয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন, সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করহার সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল। তখন আজকের মতো একটি শ্রেণির হাতে এত সম্পদ পুঞ্জীভূত হওয়ার সুযোগ ছিল না। অর্থাৎ সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও আজকের মতো এত বৈষম্য ছিল না। হয়তো সমাজতন্ত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে তাকে এটা করতে হয়েছে।

কিন্তু ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের অভিঘাত সামলাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেয়। এরপর প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান সেটা আরও এগিয়ে নেন। অর্থনীতির পরিভাষায় যাকে বলা হয় নিওলিবারেলিজম বা নব্য উদারনীতিবাদ। বলা যায়, আজকের তীব্র বৈষম্যের বীজ এর মধ্যেই নিহিত।

এর মাধ্যমে রিগ্যান প্রথমেই সর্বোচ্চ করহার ৭০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করেন, যাতে ধনীদের হাতে আরও বেশি টাকা জড়ো হয়। একই সঙ্গে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করেন তিনি। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯০-এর দশকে করপোরেশনের ব্যবস্থাপক ও সিইওদের বেতন আকাশচুম্বী হতে শুরু করে, এ সময় সিইওদের বেতন বাড়ে ৪০০ শতাংশ, অন্যদিকে শ্রমিকদের বেতন বাড়ে ৫ শতাংশেরও কম।

এই বাস্তবতায় পিকেটিসহ অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ধনীদের ওপর আরও বেশি করারোপ করা উচিত। এমনকি বিল গেটসের মতো অনেক ধনী মনে করেন, ধনীদের আরও কর দেওয়া উচিত।

ইনইকুয়ালিটি কিলস

অক্সফামের এ বছরের প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘ইনইকুয়ালিটি কিলস’, অর্থাৎ অসমতা মৃত্যুর কারণ। নজিরবিহীন অর্থনৈতিক অসমতা কীভাবে মৃত্যু ডেকে আনে, এই প্রতিবেদন তার ধারাবিবরণী। অর্থনৈতিক বিভাজন, অনাহার, স্বাস্থ্যসেবার অভাব, জলবায়ু বিপর্যয়, আর্থিক কারণে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা—এসব কারণে মৃত্যুহার বাড়ে। পৃথিবীতে যদি আরও সমতা থাকত, তাহলে নাকি প্রতিদিন ২১ হাজারের বেশি মানুষের কম মৃত্যু হতো।

বিশ্বের বড় একটি জনগোষ্ঠী যেকোনো সময় দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। কোভিডের মতো মহামারি তাদের এক ধাক্কায় সীমার নিচে ঠেলে দেয়। অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সম্প্রতি এ প্রসঙ্গে বলেন, ঝুঁকিতে থাকা মানুষেরা যেন পানিতে সারা শরীর নিমজ্জিত রেখে নাকটা ভাসিয়ে রাখেন। ঢেউ আসলেই এরা ডুবে যায়। এ অবস্থা সুখকর নয়।