বড় শিল্পে নারী বেশি, এসএমইতে কম

অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও ভারী বা বড়—এ চার ধরনের শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের ৪৪ শতাংশ নারী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নারী ভারী শিল্পে।

তৈরি পোশাক কারখানা।
ফাইল ছবি

দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে (এসএমই) নারীরা কাজে সুযোগ কম পাচ্ছেন। অথচ দেশে এখন সবচেয়ে বেশি শিল্পকারখানা রয়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে। এসএমই খাতে নারীর অংশগ্রহণ কম হলেও বড় বা ভারী শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের চেয়ে বেশি। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।

বিবিএসের কর্মকর্তারা বলছেন, ভারী শিল্পে নারীরা নিজেদের যোগ্যতায় ভালোভাবেই টিকে আছেন। ভারী শিল্পে কাজ করতে পারলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পেও নারীদের পক্ষে কাজ করা সম্ভব। কিন্তু জরিপের তথ্য বলছে, এসএমই খাতে পুরুষের তুলনায় নারীদের কাজ করার হার বেশ কম।

বিবিএসের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, শিল্পকারখানায় মালিক, স্বত্বাধিকারী, অংশীদারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে পুরুষের একচ্ছত্র আধিপত্য। এসব পদে নারীদের অবস্থান খুবই দুর্বল। একইভাবে প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপক পদেও পুরুষের আধিক্য। বিক্রয়কর্মী পদেও পুরুষের তুলনায় নারীরা পিছিয়ে। তবে উৎপাদন ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পদে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি।

জরিপের তথ্য বলছে, ১০ জনের বেশি শ্রমিক কাজ করেন, দেশে এখন এমন শিল্পকারখানার সংখ্যা ৪৬ হাজার ১১০। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিল্প পাওয়া গেছে ক্ষুদ্রশিল্পে ২৩ হাজার ৩০৬টি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারখানা রয়েছে অতিক্ষুদ্র শিল্পে, ১৬ হাজার ৭৭০টি। তৃতীয় সর্বোচ্চ কারখানা আছে মাঝারি শিল্পে—৩ হাজার ১৭৮টি। আর বড় কারখানা আছে ২ হাজার ৮৫৬টি।

বিবিএস জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ১০ থেকে ২৪ জন শ্রমিক দিয়ে পরিচালিত এমন অতিক্ষুদ্র শিল্পে নারীশ্রমিক কাজ করছেন মাত্র ১৯ শতাংশ। তার মানে হলো অতিক্ষুদ্র শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের ৮১ শতাংশই পুরুষ। ২৫ থেকে ৯৯ জন শ্রমিক নিয়ে পরিচালিত ক্ষুদ্র শিল্পের শ্রমিকের মাত্র ২০ শতাংশ নারী। অর্থাৎ এ শিল্পের বাকি ৮০ শতাংশই পুরুষ শ্রমিক। ১০০ থেকে আড়াই শ শ্রমিক নিয়ে পরিচালিত মাঝারি শিল্পে কর্মরত আছেন ২৬ শতাংশ নারী। এ খাতে কর্মরত বাকি ৭৪ শতাংশ পুরুষ। আর ২৫০–এর বেশি শ্রমিক নিয়ে পরিচালিত বড় শিল্পে কর্মরত আছেন ৫৫ শতাংশ নারী। বড় শিল্পে পুরুষ শ্রমিক নারীর চেয়ে কম—৪৫ শতাংশ।

দৈবচয়নের ভিত্তিতে দেশের ৮ হাজার ৫৩৩ শিল্পকারখানার ওপর জরিপটি পরিচালনা করেছে বিবিএস। ২০২০ সালে এ জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। গত সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকভাবে জরিপের এ ফল প্রকাশ হয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের শিল্পনীতি ২০১০–এর আলোকে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড়—এই চার শ্রেণির আলোকে শিল্পকারখানার সংখ্যা বের করা হয়েছে জরিপে। তাতে দেখা গেছে, এই চার শ্রেণির কারখানায় এখন মোট ৫৪ লাখ ৬৫ হাজার ১৬২ জন শ্রমিক কর্মরত আছেন। এর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৩০ লাখ ৬৫ হাজার ৬১৭। ৫৬ শতাংশ। আর নারীর সংখ্যা ২৩ লাখ ৯৯ হাজার ৫৪৫ জন। অর্থাৎ শিল্প খাতের মোট শ্রমিকের ৪৪ শতাংশ নারী।

জরিপের তথ্য অনুযায়ী, শিল্পকারখানায় মালিকানায় বা স্বত্বাধিকারী পদে পুরুষের সংখ্যা যেখানে ৬০ হাজার ২৫৮ জন, সেখানে নারীর সংখ্যা মাত্র ২ হাজার ৯৯৪ জন। প্রশাসনিক পদে পুরুষের সংখ্যা দুই লাখ ৬১ হাজার ৮৪ জন। আর নারী কর্মরত আছেন ২০ হাজার ৭০৫ জন। বিক্রয়কর্মী পদে পুরুষের সংখ্যা ১ লাখ ৩৫ হাজার ২৮৫ জন। আর নারী রয়েছেন ২৪ হাজার ২২ জন। আর উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত পুরুষের সংখ্যা ২৫ লাখ ৪৩ হাজার এবং নারীর সংখ্যা ২২ লাখ ৯৪ হাজারের বেশি।

জানতে চাইলে বিবিএসের এ জরিপের ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা লিজেন শাহ নঈম প্রথম আলোকে বলেন, দেশে মাঝারি শিল্পের সংখ্যা অন্যান্য শিল্পের তুলনায় কম। তাই এ খাতে নতুন নতুন আরও উদ্যোক্তা তৈরির পাশাপাশি শ্রমিকের কর্মসংস্থানের বড় ধরনের সুযোগ আছে। আমাদের বেশির ভাগ শিল্পকারখানা এখনো আমদানিনির্ভর। এ কারণে কর্মসংস্থানের পরিমাণ কম।

বিবিএসের জরিপের তথ্য বলছে, দেশে অতিক্ষুদ্র থেকে ভারী শিল্পে কর্মরত শ্রমিকের ৭৯ শতাংশই দক্ষ। বাকি ১৯ শতাংশ অদক্ষ শ্রমিক। এক বছরে এই চারটি খাতে মজুরিসহ অন্যান্য সুবিধার আর্থিক মূল্য ৭৬ হাজার ৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মজুরি বিতরণ করা হয় বড় শিল্পকারখানা থেকে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৫৬ হাজার ৭২ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মজুরি দেওয়া হয় ক্ষুদ্র শিল্প থেকে। যার পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। মাঝারি শিল্পমালিকেরা বছরে বেতন–ভাতা বাবদ পরিশোধ করেন ৬৫০ কোটি টাকা। আর অতিক্ষুদ্র শিল্প কারখানাগুলো বেতন–ভাতা বাবদ বছরে খরচ করে ২৬৭ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন মাসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বড় শিল্পে যেসব নারী শ্রমিক কাজ করেন, তাঁরা একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে আছেন। কিন্তু ক্ষুদ্র শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকেরা বেশির ভাগই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। সেখানে কোনো আইনি কাঠামো নেই। সে কারণে জরিপে ক্ষুদ্র শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ কম দেখানো হয়েছে। তিনি বলেন, রাজধানীর উপকণ্ঠে সাভারের ভাকুর্তায় গয়নাশিল্পের সঙ্গে ১৫ থেকে ২০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। এর মধ্যে বেশির ভাগই নারী। কিন্তু তাঁরা অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছেন। সে কারণে ক্ষুদ্র শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ কম।