মালা শাড়ির আনোয়ার হোসেন

আনোয়ার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে তাঁর সন্তানদের মধ্যে চারজন—মানোয়ার হোসেন, হোসেন মেহমুদ, হোসেন খালেদ ও সেলিনা তারেক। ছবি: প্রথম আলো
আনোয়ার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে তাঁর সন্তানদের মধ্যে চারজন—মানোয়ার হোসেন, হোসেন মেহমুদ, হোসেন খালেদ ও সেলিনা তারেক। ছবি: প্রথম আলো
দেশের পুরোনো উদ্যোক্তাদের একজন আনোয়ার হোসেন। অনেকেই তাঁকে মালা শাড়ির আনোয়ার হোসেন নামে চেনেন। ছোট থেকে শুরু করেছিলেন, এখন আনোয়ার গ্রুপ দেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী। আনোয়ার হোসেনের পরবর্তী প্রজন্ম এর হাল ধরেছে।

মালা শাড়ি, বাংলাদেশের শাড়ির জগতে প্রথম সুপরিচিত ব্র্যান্ড। দেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে এই শাড়ি এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, বিয়ে মানেই ছিল মালা শাড়ি। বাজারে তখন আমদানি করা এবং অবাঙালিদের কারখানায় উৎপাদিত বিভিন্ন শাড়ি ছিল। সব শাড়িকে হটিয়ে বাজার দখল করে মালা শাড়ি। 

মালা শাড়ির উদ্যোক্তা আনোয়ার হোসেন। আজকের আনোয়ার গ্রুপ নামের যে বড় শিল্পগোষ্ঠী, আনোয়ার হোসেন তারই প্রতিষ্ঠাতা। দেশের কয়েকটি পুরোনো ও সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্পগোষ্ঠীর নাম উল্লেখ করলে আনোয়ার গ্রুপকে রাখতেই হবে। 

আনোয়ার হোসেনদের পারিবারিক ব্যবসা অনেক পুরোনো। তবে তিনি নিজে পরিচিতি পেয়েছিলেন মালা শাড়ি দিয়ে। সবাই তাঁকে বলতেন, মালা শাড়ির আনোয়ার। ১৯৬৮ সালে আনোয়ার হোসেন আনোয়ার সিল্ক মিলস প্রতিষ্ঠা করে মালা শাড়ি বাজারে আনেন। গত শতাব্দীর আশির দশকেও বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি জনপ্রিয় জিঙ্গেল ছিল ‘মালা শাড়ি না দিলে বিয়া করমু না’। 

আনোয়ার গ্রুপ এখন বস্ত্র, পাট, সিমেন্ট, ইস্পাত, ব্যাংক, বিমা, গাড়ি, আবাসন, অবকাঠামো, আসবাবসহ ৩৬টি পণ্য ও সেবা খাতের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। গ্রুপটির অধীনে কোম্পানি রয়েছে ২০টি। 

অবশ্য এসব আনোয়ার হোসেনের মূল পরিচয় নয়। তাঁর পরিচয়, তিনি গুটিকয়েক বাঙালি উদ্যোক্তার একজন, যাঁদের হাতে বাংলাদেশের আজকের শিল্প–সক্ষমতা গড়ে উঠেছে। 

১৮৩৪ সালে শুরু
আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৩৮ সালে। তাঁদের পারিবারিক ব্যবসার শুরু তারও ১০৪ বছর আগে, ১৮৩৪ সালে। ওই বছর তখনকার কুন্ডু রাজার কাছ থেকে চকবাজারে বছরে এক টাকা খাজনায় একটি ভিটা ইজারা নেন আনোয়ার হোসেনের দাদা লাক্কু মিয়া (আসল নাম লাট মিয়া)। এই ইজারার দলিলপত্র এখনো সংরক্ষিত আছে। ফলে এখন আনোয়ার হোসেনের পরিবারের ব্যবসার বয়স দাঁড়িয়েছে ১৮৩ বছর। 

লাট মিয়ার মূল ব্যবসা ছিল শিং দিয়ে চিরুনি ও বোতাম তৈরি করে বিক্রি করা। আনোয়ার হোসেনের বাবার নাম রহিম বখ্স। তিনি (রহিম বখ্স) বাবার ব্যবসাকে বড় করেন। শিংয়ের চিরুনির পাশাপাশি কাপড়সহ আরও কিছু পণ্যের ব্যবসা করতেন তিনি। আনোয়ার হোসেন উল্লেখ করেছেন, ১৯৪৫ সালে ৮৫ বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগে রহিম বখ্স ছিলেন ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলে মুসলমানদের মধ্যে চারজন সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর একজন। বাকি তিনজন ছিলেন গফুর মহাজন, আফতাব উদ্দিন মহাজন ও মহিউদ্দিন খান মহাজন। 

রহিম বখ্স পুরান ঢাকার আলমীগোলায় (লালবাগে) পরিবার নিয়ে বাস করতেন। যদিও আনোয়ার হোসেন দেশের স্বাধীনতার পরে ধানমন্ডিতে বসবাস করা শুরু করেন। 

১৫ বছর, ৪৮০ টাকা
আনোয়ার হোসেনের নিজের ব্যবসা শুরু ১৯৫৩ সালে। এর আগে কয়েক বছর তিনি পারিবারিক ব্যবসা সামলেছেন। 

১৯৪৫ সালে আনোয়ার হোসেনের বাবার মৃত্যু হয়। তখন তাঁর বয়স সাত বছর। বাবার মৃত্যুর পর পারিবারিক ব্যবসা বিপাকে পড়ে যায়। বিশ্বস্ত কর্মচারীদের কয়েকজন টাকাপয়সা আত্মসাৎ করেন। 

আনোয়ার হোসেনের মায়ের কাছে তাঁর বাবা রহিম বখ্স আট ইঞ্চি লম্বা আর তিন ইঞ্চি পুরুত্বের একটি সোনার ইট আর কিছু রুপার টাকা রেখে গিয়েছিলেন। অনেক বছর এ কথা মা সন্তানদের জানতে দেননি। কলসিতে ভরে মুরগির খোঁয়াড়ে লুকিয়ে রেখেছিলেন। আনোয়ার হোসেন উল্লেখ করেন, মা চেয়েছিলেন ছেলেরা যেন নিজেরা স্বাবলম্বী হয়। অল্প বয়সে এত টাকা পেলে বখে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। 

মাত্র ১২ বছর বয়সে বাবার ব্যবসা সামলানোর দায়িত্ব পড়ে আনোয়ার হোসেনের ওপর। তার আগে তাঁর বড় ভাই তাঁকে নিজেদের দোকানের পাশে ভোলা মিঞা নামের এক ব্যক্তির দোকানে কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। সকাল থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত পড়াশোনা, এরপর দোকানে কাজ। আনোয়ার হোসেনের ভাতা ছিল মাসে ১৫ টাকা। আর দৈনিক ২ আনা নাশতার খরচ। 

একসময় বড় ভাই আনসার বাহিনীতে যোগ দিলে আনোয়ার হোসেনকেই ব্যবসা সামলাতে হয়। কিছুকাল পর বড় ভাই আবার ব্যবসায় ফিরে আসেন। আনোয়ার হোসেন নিজে কিছু করার চিন্তা শুরু করেন। ভোলা মিঞার দোকানে কাজ করে জমানো ৯০ টাকাই সম্বল। মা দিলেন ২০০ রুপার মুদ্রা, যা বিক্রি করে পাওয়া গেল ৩৯০ টাকা। মোট মূলধন ৪৮০ টাকায় ১৯৫৩ সালে চকবাজারে ২২০ নম্বর দোকান নিলেন তিনি। নাম দিলেন আনোয়ার ক্লথ স্টোর। বয়স তখন মাত্র ১৫ বছর। 

আনোয়ার হোসেনের প্রথম ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আনোয়ার ক্লথ স্টোর। দোকানে অন্যদের সঙ্গে আনোয়ার হোসেন (সর্ব ডানে)। ছবি: আনোয়ার গ্রুপের সৌজন্যে
আনোয়ার হোসেনের প্রথম ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আনোয়ার ক্লথ স্টোর। দোকানে অন্যদের সঙ্গে আনোয়ার হোসেন (সর্ব ডানে)। ছবি: আনোয়ার গ্রুপের সৌজন্যে

লুঙ্গির গাঁটরি আর মুড়ি-পেঁয়াজি
দোকান দেওয়ার পর আনোয়ার হোসেনকে কঠোর পরিশ্রম শুরু করতে হলো। ঢাকার রায়েরবাজারে তখন হাট বসত। সেখানে তিনি লুঙ্গির গাঁটরি মাথায় করে নিয়ে যেতেন। পরনে লুঙ্গির ভাঁজে থাকত মুড়ি আর পেঁয়াজি। খিদে পেলে তাই খেতেন। 

ব্যবসা বাড়তে থাকে। একসময় চকবাজারে পাশের ছয়টি দোকান কিনে নেন আনোয়ার হোসেন। লুঙ্গি থেকে কাপড়, এরপর শাড়ি, ব্যবসা বাড়ছিল। আনোয়ার হোসেন নামেন ঢেউটিন আমদানির ব্যবসায়—সবই ১৯৫৩ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে। 

বাণিজ্যে ভালো করছিলেন ঠিকই, কিন্তু আনোয়ার হোসেনের ইচ্ছা ছিল শিল্পকারখানা করার। ১৯৫৬ সালে বাড়িতে শাড়ির ছাপাখানা চালু করেছিলেন। সেটা সেই অর্থে শিল্প ছিল না। ১৯৬৮ সালে তিনি একটি সিল্ক মিল কিনে নিয়ে চালু করলেন আনোয়ার সিল্ক মিলস। তৈরি হলো মালা শাড়ির ইতিহাস। 

তখন ঢাকার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলায় আনোয়ার হোসেনের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে। দোকান, কার্যালয়, বাড়ি-গাড়ি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতেও। 

পত্রিকায় প্রকাশিত মালা শাড়ির একটি বিজ্ঞাপন
পত্রিকায় প্রকাশিত মালা শাড়ির একটি বিজ্ঞাপন

জিন্নাহর জনসভায়
আনোয়ার হোসেন তাঁর আট দশকের জীবনে দুর্ভিক্ষ দেখেছেন, ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়া দেখেছেন, ভাষা আন্দোলন দেখেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দেখেছেন। দেখেছেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও। তাঁর বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন (১৯৪৩ সালে) বাংলায় শুরু হয় দুর্ভিক্ষ।

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ শেষবারের মতো যখন ঢাকায় আসেন, তখন আনোয়ার হোসেনের বয়স ১০ বছর। ঢাকার তখনকার রেসকোর্স ময়দানে জিন্নাহর জনসভায় কিশোর আনোয়ার হোসেনও উপস্থিত ছিলেন, গিয়েছিলেন এলাকার নান্নু ভাইয়ের সঙ্গে। জিন্নাহ ভাষণ দিয়েছিলেন ইংরেজি আর উর্দুতে। যার বেশির ভাগই বুঝতে পারেননি আনোয়ার হোসেন। অবশ্য বুঝিয়ে দেন নান্নু ভাই।

আনোয়ার হোসেন উল্লেখ করেন, জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার পর উপস্থিত জনতার কেউ কেউ ক্ষোভে ফেটে পড়ে ‘ধর ধর’ বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আনোয়ার হোসেনের বয়স ৩৩ বছর। তিনি সে সময় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তিনি উল্লেখ করেন, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রবের মতো ছাত্রনেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল তাঁর। রাজনৈতিক নেতারা বা মুক্তিযোদ্ধারা যখনই যেতেন, যথাসম্ভব সহায়তা করতেন তিনি।

২৪ এপ্রিল চকবাজারে আগুন দেয় পাকিস্তানি সৈন্যরা। পুড়ে যায় আনোয়ার হোসেনের দোকান। আগুন দেখে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। পরে সিরাজ নামের এক ‘গুন্ডা’ এসে জানায়, তাঁর সব পণ্য পুড়ে যায়নি। আগুন দেওয়ার পর দোকান ভেঙে সিরাজ বেশ কিছু মালামাল উদ্ধার করে। মুক্তিযুদ্ধের আগে চকবাজারেই ৪২০ জন ব্যবসায়ীর কাছে ২০ লাখ টাকা পেতেন আনোয়ার হোসেন। সারা দেশে ৯টি গদিতে (বিক্রয়কেন্দ্র) মোট হাজারখানেক লোকের কাছে পাওনা ছিল। কেউ ফেরত দিয়েছেন, কেউ দেননি। অনেক পণ্যও খোয়া গেছে। কিন্তু আবার ব্যবসা শুরু করেছেন তিনি। 

আনোয়ার হোসেন উল্লেখ করেন, ‘স্বাধীনতার পর অর্থনীতি মৃতপ্রায়। রাষ্ট্রীয় প্রতিটি ক্ষেত্রে পুনর্গঠনের প্রয়োজন হয়। …পরনির্ভরশীলতা কাটাতে কাজ শুরু করলাম আমি ও আমার মতো কয়েকজন উদ্যোক্তা।’ 

পরিবার
আনোয়ার হোসেনের স্ত্রীর নাম বিবি আমেনা। আনোয়ার-আমেনা দম্পতির সাত সন্তান। চার মেয়ে ও তিন ছেলে। প্রথম তিন সন্তান মেয়ে—শাহীন বেগম, সেলিনা বেগম মালা ও হাসিনা বেগম রুমা। আরেক মেয়ের নাম শাহনাজ বেগম মুন্নী। আনোয়ার হোসেনের বিখ্যাত মালা শাড়ির নাম দেওয়া হয় দ্বিতীয় সন্তান সেলিনা বেগম মালার নাম অনুসারে। 

চতুর্থ সন্তান মানোয়ার হোসেন, যিনি এখন আনোয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আনোয়ার সিমেন্ট, আনোয়ার স্টিল মিলস, আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, মানোয়ার ইন্ডাস্ট্রিজ ও সানশাইন কেব্​লসের ব্যবসা সামলান তিনি। মেজ ছেলের নাম হোসেন মেহমুদ। টেক্সটাইলে বিশেষ আগ্রহ থাকায় তিনি এখন হোসেন ডায়িং অ্যান্ড প্রিন্টিং, মেহমুদ ইন্ডাস্ট্রিজ, আনোয়ার সিল্ক, আনোয়ার টেক্সটাইল ও আনোয়ার টেরিটাওয়েলের ব্যবসা দেখাশোনা করেন তিনি। 

ছোট ছেলে হোসেন খালেদ। তিনি দেখাশোনা করেন আনোয়ার জুট মিলস, এজি অটোমোবাইলস, বাংলাদেশ ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানিসহ কয়েকটি ব্যবসা। হোসেন খালেদ সবচেয়ে কম বয়সে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি হন। 

হোসেন খালেদের স্ত্রী আনিকা ফারহীন বিয়েতে মালা শাড়ি পরেছিলেন। বিয়ের আগে ভাইয়ের হবু স্ত্রীকে মালা শাড়ি উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন আনোয়ার হোসেনের মেয়েরা। আকদের দিন হোসেন খালেদের স্ত্রী সেটিই পরে আসেন। 

আনোয়ার হোসেন ধানমন্ডিতে বাড়ি কেনেন ১৯৭৩ সালে। পুরান ঢাকার আলমীগোলা ছেড়ে পরের বছর সেখানে ওঠেন পরিবারসহ। ওই বাড়িতেই নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় ধারাবাহিক সকাল-সন্ধ্যা চিত্রায়িত হয়েছিল। আনোয়ার হোসেনের ছোট মেয়ে মুন্নী আর তাঁর (আনোয়ার হোসেনের) বড় ভাইয়ের ছেলে মঞ্জু অভিনয় করেছিলেন ওই নাটকে। 

আনোয়ার হোসেনের পুরান ঢাকার বাড়িটি এখনো আছে। সেখানে পরিবারসহ বাস করেন তাঁর বড় মেয়ে শাহীন বেগম। 

 নতুন উদ্যোগে অগ্রণী
স্বাধীনতার আগে বাঙালিদের মধ্যে বড় ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল খুবই কম। শিল্পোদ্যোক্তা ছিল হাতে গোনা। আনোয়ার হোসেন ছিলেন তাঁদের একজন। দেশীয় ব্র্যান্ডের জনপ্রিয় শাড়ি, দেশীয় উদ্যোক্তার মালিকানায় বস্ত্রশিল্প, দেশীয় মালিকানার কারখানায় উৎপাদিত চামচ-কাঁটাচামচ, বেসরকারি ব্যাংক-নতুন নতুন উদ্যোগে তিনি ছিলেন অগ্রণী। 

১৯৭৮ সালে ৪০ জন ব্যবসায়ীর একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আনোয়ার হোসেন তখনকার রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। সেখানে গিয়ে কেউ ব্যাংকের কথা বললেন না। প্রসঙ্গটি তুললেন আনোয়ার হোসেন। বললেন, দেশে বেসরকারি ব্যাংক দরকার। নানা যুক্তিতর্কের পর রাজি হলেন জিয়াউর রহমান। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হলো দি সিটি ব্যাংক, চারবার সেটির চেয়ারম্যান ছিলেন আনোয়ার হোসেন। 

রাজনীতিতে যোগ দিয়ে তিন বছর সাংসদ (ঢাকা-৮ আসনের) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন আনোয়ার হোসেন। এরপর এরশাদ সরকারের পতন হয়। পড়ে আনোয়ার হোসেন আর রাজনীতির পথে পা বাড়াননি। 

দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর মধ্যে স্বনামধন্য ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) আজকের অবস্থানে আসার পেছনেও বড় ভূমিকা ছিল আনোয়ার হোসেনের। তিনি এবং সাবেক সভাপতি মাহবুবুর রহমান (এখন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশ বা আইসিসিবির সভাপতি) মূলত সংগঠনটির অভিভাবক। তাঁরা দুজন আবার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মাহবুবুর রহমান উল্লেখ করেছেন, চাইলে আনোয়ার হোসেন অনেকবার ডিসিসিআইয়ের সভাপতি হতে পারতেন। কিন্তু হননি। বরং ১২ জনকে সভাপতি হতে সহায়তা করেছেন। 

হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, সামাজিক সংগঠনে সহায়তায় উদারহস্ত আনোয়ার হোসেন। নিজের নামে একটি ফাউন্ডেশনও প্রতিষ্ঠা করেছেন, যেটি সামাজিক কল্যাণে ভূমিকা রাখছে। 

আনোয়ার গ্রুপের প্রথম কারখানা—আনোয়ার সিল্ক মিলস
আনোয়ার গ্রুপের প্রথম কারখানা—আনোয়ার সিল্ক মিলস

‘শেষের কবিতা’
আনোয়ার হোসেন নিজের আত্মজীবনী লিখেছেন, যার নাম আমার আট দশক। এই লেখায় যেসব উদ্ধৃতি ও তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে, তার কোনোটাই আনোয়ার হোসেনের নিজের মুখ থেকে শোনা নয়। তিনি স্মৃতিশক্তি হারানোর রোগ বা ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। রোগটি ধরা পড়ে ২০১২ সালে। 

আনোয়ার হোসেন পছন্দ করতেন ঘুরে বেড়াতে। পুরো বাংলাদেশের পাশাপাশি বহু দেশ ঘুরেছেন তিনি। গান শুনতেন, সিনেমা দেখতেন। প্রিয় খেলা ছিল কাবাডি। নিজের তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও সন্তানদের দেশে-বিদেশে পাঠিয়ে উচ্চশিক্ষা দিয়েছেন। 

আনোয়ার হোসেনের পছন্দের খাবার ছিল চিংড়ির দোপেঁয়াজি আর গরুর মাংসের কোপ্তা। পুরান ঢাকার রশীদ দেলওয়ালের ফালুদা, লাসানীর শিক কাবাব, ইসলামপুরের শানু পালোয়ানের মোরগ পোলাও, চকবাজারের লতিফের তেহারিও ছিল তাঁর পছন্দের তালিকায়। 

ঢাকায় এখন বহু রেস্তোরাঁ হয়েছে, কিন্তু ইসলামপুরের শানু পালোয়ানের মোরগ পোলাও আর নেই। জীবনের মুখর আটটি দশক পেরিয়ে আনোয়ার হোসেনও এখন অবসরে। স্মৃতিশক্তি তেমন একটা নেই। শুধু স্বজনদের আর পুরান ঢাকার পুরোনো মানুষদের চিনতে পারেন। প্রিয় বন্ধু মাহবুবুর রহমান দেখা করতে গেলেই জড়িয়ে ধরেন। 

জীবনে যা করেছেন, যা পেয়েছেন, বাকি কি কিছু ছিল? জবাব দেন আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে হোসেন খালেদ। তিনি বলেন, ‘বাবার হয়তো একটাই কষ্ট রয়ে গেছে। তিনি চেয়েছিলেন নিজের কর্মজীবনেই ২০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান করবেন। ১৪ হাজারের মতো করেছেন। আমরা কর্মসংস্থানের সংখ্যা ২০ হাজারে উন্নীত করতে কাজ করছি।’ 

আনোয়ার হোসেনের বয়স এখন ৮১ বছর। তিনি নিজের আত্মজীবনীর শেষ অনুচ্ছেদের নাম দিয়েছেন শেষের কবিতা, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত উপন্যাসের নামে। সেখান থেকে উদ্ধৃত করেছেন তিনটি লাইন, ‘তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান; গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়। হে বন্ধু, বিদায়।

একনজরে আনোয়ার হোসেন

● জন্ম ১৯৩৮ সালে, ব্যবসা শুরু ১৯৫৩ সালে।
● প্রথম বড় কারখানা আনোয়ার সিল্ক মিলস, ১৯৬৮।
● নিজের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান প্রায় ২৬টি।
● কর্মসংস্থান করেছেন প্রায় ১৪ হাজার মানুষের।

আনোয়ার গ্রুপ এখন

● মোট কোম্পানি ২০টি।
● বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ২২%।
● ব্যবসার খাত: বস্ত্র, পাট, সিমেন্ট, ইস্পাত, আবাসন, পলিমার, আসবাব, অটোমোবাইল, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোম্পানি ইত্যাদি।

ব্যবসা–কৌশল

● ক্রেতার চাহিদার সঙ্গে মান ও মূল্যের সমন্বয় হলে যেকোনো পণ্য চলতে বাধ্য।
● ব্যবসায় আগে পণ্য কেনাটাই বড় বিষয়। পণ্য কেনার ক্ষেত্রে ঠকে গেলে বিক্রিতে লাভ করা যায় না।
● নতুন কিছু করতে সহজভাবে চিন্তা করতে হবে। বড় সমস্যার সহজ সমাধান ব্যবসার সফলতা আনে।

পরামর্শ

● মেহনত করো। সৎ পথে বুদ্ধিমানের মতো খাটতে থাকো, পুরস্কার পাবেই। 
● যে কাজটা আগামীকাল করবে ভেবেছ, তা আজই করো। আজ যে কাজ করতে পারবে, সেটা কর এখনই।
● কর্মীদের দেখে রেখ, তারাই ব্যবসা দেখে রাখবে। কাউকে অসম্মান করা যাবে না। 

চাকচিক্য নয়, আমরা বড় হয়েছি সাধারণভাবে

মানোয়ার হোসেন
গ্রুপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আনোয়ার গ্রুপ

মানোয়ার হোসেন
মানোয়ার হোসেন

যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা শেষ করে ১৯৯৩ সালে আমি ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আনোয়ার গ্রুপে যোগদান করি। তবে ছোটবেলা থেকেই বাবা (আনোয়ার হোসেন) আমাকে একটু একটু করে ব্যবসা শিখিয়েছেন। বিদেশে পড়াশোনার ফাঁকে দেশে ছুটিতে এলে বাবা আমাকে কারখানায় নিয়ে যেতেন।

বাবা ঘুরতে বেশ পছন্দ করতেন। পুরো বাংলাদেশ ওনার নখদর্পণে ছিল। কোন গলিতে কার দোকান, তাঁর মোটামুটি মুখস্থ ছিল। প্রতিদিন তিনি কারখানায় যেতেন। আমি সঙ্গে থাকলে বলতেন, ‘আমি আমার লোকজনকে দেখে রাখলে তারা আমার কারখানা দেখে রাখবে। আমি তো আসব আধা ঘণ্টা-এক ঘণ্টা, বড়জোর দুই ঘণ্টা। মিল তো থাকবে ওদের হাতে। ফলে ওদের দেখে রাখবা।’

দেশের সেরা একজন শিল্পপতির ঘরে বেড়ে উঠেছি আমরা চার বোন ও তিন ভাই। তবে কোনোরকম চাকচিক্যের মধ্যে বাবা আমাদের বড় করেননি। টাকাপয়সা ওড়ানোর মতো কোনো বিষয় আমাদের মাথায় ঢুকতে দেননি। সাংঘাতিক শক্তভাবে তিনি (বাবা) আমাদের ভাইবোনকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। তিনি প্রায়ই একটা উপদেশ দিতেন, ‘পড়ালেখা করবা। আর কিছু না পারো, অন্তত মাস্টারি করে খাইতে পারবা।’

ছোটবেলায় যখন দেশে থাকতাম, তখন বিদেশ থেকে বাবার যত চিঠি আসত, আমি তা পড়ে শোনাতাম। টেলেক্স পড়ে শোনাতাম। অনেক সময় তিনি আমাকে দিয়ে চিঠি লেখাতেন। বাবা কারখানার খরচ বোঝাতেন—‘এখানে জায়গায় খরচ বেশি হচ্ছে, ওখানে জায়গায় খরচ কম হচ্ছে। সব সময় খেয়াল রাখবা, খরচ যেন না বাড়ে। খরিদ করাতেই তোমার লাভ।’ মূলত বাবার সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে আধা ব্যবসায়ী হয়েছি আমি। ছুটিতে এসে বাবার ঋণপত্র খুলতাম। এটি আমাকে বেশ সাহায্য করেছে।

১৯৬৮ সালে বাবা টেক্সটাইল কারখানা করেন। সেখানেই প্রথম মালা শাড়ি তৈরি হয়। সেই শাড়ির জনপ্রিয়তা ছিল অন্য রকম। তখন কোনো বাড়িতে মালা শাড়ি ছাড়া বিয়েই হতো না। পত্রিকা ও টেলিভিশনে মালা শাড়ির বিজ্ঞাপন যেত। সেই বিজ্ঞাপন করতেন সে সময়কার শীর্ষ অভিনেতারা। বাবা ব্র্যান্ডিং বিষয়টা খুবই ভালো বুঝতেন। তাঁর কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা ছিল না। বোধ হয় ক্লাস ফোর–ফাইভ পর্যন্ত পড়েছেন। দাদা মারা যাওয়ার পর অল্প বয়সে ব্যবসার হাল ধরতে হয়েছিল। তবে ব্যবসায় যেসব বিষয় তিনি চর্চা করতেন, আজকাল তেমনটাই আমরা বিভিন্ন বই পড়ে শিখি।

বাবার ব্যবসায়িক জীবনের সফলতার পেছনের রহস্য জানতে চান অনেকে। আমি মনে করি, দাদির প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধা বাবাকে এতদূর নিয়ে এসেছে। দাদি যেটা বলতেন, তাঁর ওপরে কোনো কথা বলতেন না। আমি ছোটবেলায় বেশ দুষ্টু ছিলাম। মারটার খাওয়ার মতো পরিস্থিতি হলেই দাদির কাছে চলে যেতাম। একবার বাবা আমাকে মার দিলেন। তখন আমার বয়স ১২-১৩ বছর। বাবার ৪০ বছর। আমার খেয়াল আছে, আমাকে মার দেওয়ার জন্য দাদি বাবাকে কান ধরতে বললেন। দাদি তাঁকে দশবার ওঠালেন–বসালেন। ৪০ বছরের একটা মানুষ কিন্তু তাঁর ছেলের সামনে কান ধরে ওঠবস করলেন। কারণ, মায়ের আদেশ। কোনো দিনই দাদিকে সালাম না দিয়ে বাড়ি থেকে বের হতেন না।

বাবা প্রায়ই একটা উপদেশ দিতেন, ‘কালকের কাজ আজকে। আজকের কাজ এক্ষুনি। অফিস থেকে যখন যাবা, তখন টেবিল খালি করে দিয়ে যাবা। তুমি এক মানোয়ার একটা কাগজে সই না করলে হয়তো ৫০০ লোকের বেতন হবে না। নয়তো একটি মেশিন চলবে না।’ উপদেশটি মেনে চলার চেষ্টা করি। বাবা শ্রমিকদের সঙ্গে খুব কথা বলতেন। সব সময় কাজটি করতে পারি না। তবে মাঝেমধ্যে চেষ্টা করি।

রাতের বেলা আমরা তিন ভাই একসঙ্গে ফুটবল খেলি। আমাদের বাচ্চারা বিদেশে পড়ে। তারা দেশে ফিরলে আমরা একসঙ্গে ফুটবল খেলি। মাঝেমধ্যে আমি রান্না করি। সব ভাইবোন আসে। আমরা এখনো একই বাসায় থাকি। আমার ভাইয়েরা আমাকে জিজ্ঞেস না করে কোনো কাজ করে না। কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে একসঙ্গে বসে আলোচনা করি। হোয়াটসঅ্যাপে আমাদের তিন ভাইয়ের একটি গ্রুপ আছে। নাম, ব্রাদার্স ইউনিয়ন। সেখানেই আমরা সব বিষয়ে বার্তা আদান–প্রদান করি। কারণ আমরা জানি, যোগাযোগ কমে গেলেই দূরত্ব তৈরি হয়।