মূল্যবৃদ্ধির পরও সংকট কমেনি

আজ শনিবার থেকে বাজারে সয়াবিন তেলের সরবরাহ বাড়তে পারে। অতিরিক্ত মুনাফা করতে কিছু দোকানি তেলের মজুত করেছেন।

বোতলজাত তেলের তীব্র সংকট বাজারে।
সংগৃহীত

মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়ার পরও দেশের প্রধান দুই শহর ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট আগের চেয়ে একটুও কমেনি। পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বেশি দাম দিয়েও সয়াবিন তেল পাচ্ছেন না ক্রেতারা। ভোজ্যতেলের বাজার স্বাভাবিক হতে আরও কয়েক দিন লাগবে বলে মনে করছেন খুচরা বিক্রেতারা।

গতকাল শুক্রবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও, কারওয়ান বাজার, কাঁঠালবাগানসহ সাতটি এলাকার ৩৪টি মুদিদোকান ঘুরে দেখা গেছে, মাত্র ছয়টি দোকানে সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে। প্রায় একই অবস্থা চট্টগ্রামেরও। শহরের ২ নম্বর গেট, বহদ্দারহাট, বিবিরহাটসহ পাঁচটি এলাকার ১৩টি দোকানে ঘুরে মাত্র ২টিতে সয়াবিন তেল পাওয়া গেছে। দোকানিরা বলছেন, কোম্পানির পরিবেশকেরা তেল সরবরাহ করছেন না।

রাজধানীর পূর্ব তেজতুরী বাজারের বাসিন্দা মো. ফিরোজ গতকাল দুপুরে সয়াবিন তেল কিনতে আসেন কারওয়ান বাজারে। আট-দশ দোকান ঘুরেও কোথাও না পেয়ে বাসায় ফিরে যান। সন্ধ্যায় আবার আসেন কারওয়ান বাজারে। এবারও একই অবস্থা। একটি দোকানের সামনে তিনি কথা বলেন প্রথম আলোর সঙ্গে। কথার একপর্যায়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘মনে হয়, বাজারের কোনো দোকান বাকি রাখি নাই। কোথাও তেল নাই। দু-তিনটি দোকানে পাঁচ লিটারের সূর্যমুখী তেল সাড়ে এগার শ টাকা চাইছে। ছোট ব্যবসা করে সংসার চালাই। এত টাকা দিয়ে কি আমাদের পক্ষে তেল কেনা সম্ভব?’

বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর সয়াবিন তেলের নতুন দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। নতুন নির্ধারিত দর অনুযায়ী, বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৩৮ টাকা বেড়ে হয়েছে ১৯৮ টাকা।

দেশে ভোজ্যতেল সরবরাহের দিক থেকে শীর্ষে থাকা দুটি বড় কোম্পানির ছয়জন কর্মকর্তার সঙ্গে গতকাল কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেছেন, সয়াবিন তেলের নতুন দাম শনিবার (আজ) থেকে কার্যকর করা হবে। একই সঙ্গে বাজারে সরবরাহও বাড়বে। খুচরা বাজারে এখন তেলের যে সংকট, তা তিন-চার দিনের মধ্যে কেটে যাবে বলে আশাবাদী তাঁরা।

শুল্ক ও করে আরও ছাড় দিয়ে সয়াবিন তেলের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনা যায় কি না, সরকারের সেই চেষ্টা করা উচিত।
সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম

এদিকে কারওয়ান বাজারের দোকানিরা জানিয়েছেন, দু-একটি তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তারা শনিবার থেকে সয়াবিন তেল সরবরাহ করবে। তবে কাঁঠালবাগান, মোহাম্মদপুর টাউন হল, মোহাম্মদপুর সলিমুল্লাহ রোড ও খিলগাঁওয়ের সিপাহীবাগের ২০ জন দোকানির সঙ্গে তেল সরবরাহকারী কোনো কোম্পানির কেউ গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত যোগাযোগ করেনি। ওই দোকানিরা জানান, যারা খুচরা বাজারে তেল সরবরাহ করে, প্রথমে তারা এসে অর্ডার নিয়ে যায়। যেহেতু এখনো কোনো কোম্পানি থেকে অর্ডার নিতে কেউ আসেনি, তাই তেলের বাজার স্বাভাবিক হতে আরও কয়েক দিন লাগবে বলে মনে করছেন তাঁরা।

কিছু দোকানে তেলের ‘মজুত’

মোহাম্মদপুরের টাউন হল সিটি করপোরেশন মার্কেটের দীপক জেনারেল স্টোর ও নেহা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে বৃহস্পতিবার যান প্রথম আলোর একজন প্রতিবেদক। দুটি দোকান থেকে বলা হয়েছিল, সয়াবিন তেল নেই। গতকাল ওই দুই দোকানে আবার যান প্রথম আলোর আরেকজন প্রতিবেদক। এর মধ্যে নেহা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গতকালও সয়াবিন তেল পাওয়া যায়নি। তবে দীপক জেনারেল স্টোরে গিয়ে সয়াবিন তেল আছে কি না জিজ্ঞেস করতেই দোকানি বলেন, ‘কয় লিটার?’

এক লিটার বলার পর দোকানি তাঁর এক কর্মচারীকে এক লিটার তেলের বোতল নিয়ে আসতে বলেন। ২০০ টাকা দিতে হবে বলেও এই প্রতিবেদককে জানান। কথায় কথায় দোকানি জানান, ঈদের চার-পাঁচ দিন আগে কোম্পানি থেকে তেল দিয়ে গেছে। এখন দুই লিটারের দু-তিনটি বোতল আছে। এর মধ্যেই দোকানে আরেকজন ক্রেতা তেল কিনতে আসেন। কিন্তু ‘তেল নেই’ বলে তাঁকে ফিরিয়ে দেন দোকানি।

টাউন হল সিটি করপোরেশন মার্কেটে তেল কিনতে আসা ক্রেতাদের অনেকে অভিযোগ করেছেন, ঈদের পর তেলের দাম বাড়বে—এমন আভাস আগেই পেয়েছিলেন দোকানিরা। যে কারণে খুচরা বিক্রেতাদের অনেকেই ঈদের আগে তেল মজুত করে রাখেন। সেই তেল এখন অনেক বেশি দামে বিক্রি করবেন তাঁরা।

উল্লেখ্য, বোতলজাত সয়াবিন তেলের প্রতি লিটারের খুচরা মূল্য ঈদের আগে ছিল ১৬০ টাকা। এখন ১৯৮ টাকা।

নাম না প্রকাশের শর্তে মোহাম্মদপুর ও সিপাহীবাগ এলাকার তিনজন দোকানি প্রথম আলোকে বলেন, কিছু দোকানির কাছে সয়াবিন তেলের মজুত আছে। নতুন তেল বাজারে সরবরাহ শুরু হলে তাঁরা বাড়তি দামে সেই তেল বিক্রি করবেন।

বোতলের চেয়ে খোলা তেলের দাম বেশি

কাঁঠালবাগান বাজারের হাজী সুলতান স্টোর মুদিদোকানে গতকাল প্যাকেটজাত ও খোলা উভয় ধরনের সয়াবিন তেলই ছিল। দোকানটি প্যাকেটজাত সয়াবিন ১৮০ টাকা লিটার এবং খোলা সয়াবিন তেল ১৯৮ টাকা লিটারে বিক্রি করছিল। দোকানি জাফর আহমেদ বলেন, এখনো নতুন দামের তেলের সরবরাহ শুরু হয়নি। তাই আগে জমা থেকে তেল ‘কিছুটা’ বাড়তি দামে তিনি বিক্রি করছেন।

কাঁঠালবাগানের ফ্রি স্কুল স্ট্রিট গলির একটি দোকানের মালিক ইসমাইল হোসেন বলেন, বাজারে সংকট শুরু হওয়ার পরপরই খোলা সয়াবিন ১৭০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছিল। তখন প্রতি লিটারের খুচরা মূল্য ছিল ১৩৬ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। যদিও বৃহস্পতিবার নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮০ টাকা।

কাঁঠালবাগানের ফ্রি স্কুল স্ট্রিট গলির বাসিন্দা রহিমা খাতুন বলেন, তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভেজে খেতে হয় এমন কিছু তিনি রান্না করেন না।

খিলগাঁওয়ের সিপাহীবাগ বাজারেও গতকাল খোলা সয়াবিন তেল বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছিল। এই বাজারের তিনটি দোকানে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ২১০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। সিপাহীবাগ বাজারের আলম জেনারেল স্টোরের দোকানি মো. শান্ত বলেন, বাজারে খোলা সয়াবিনের দাম বেশি। তাই বেশি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে। মানুষ বোতলজাত সয়াবিন তেল না পেয়ে বাধ্য হয়ে বাড়তি দামে খোলা সয়াবিন তেলই নিচ্ছে।

সিপাহীবাগ বাজারের মেসার্স রানা মসল্লা মিলস দোকানে খোলা তেল কিনতে গতকাল বিকেলে ক্রেতাদের ভিড় দেখা গেছে। এ দোকান থেকে ৩০ টাকায় তেল (দোকানির আন্দাজমতো ১০০ গ্রাম) কেনেন গৃহিণী হলুফা বেগম। পাশেই ছিলেন তাঁর স্বামী মো. হৃদয়। তিনি লেগুনার চালক।

হলুফা বেগম বলেন, ঈদের আগে আধা লিটার তেল কিনেছিলেন ১১৫ টাকায়। এখন ৩০ টাকা করে তেল কেনেন। এক থেকে দেড় দিন যায়।

সিপাহীবাগ বাজারের ওই দোকান থেকেই মেরাদিয়া মধ্যপাড়ার জমিলা বেগম ১০০ টাকায় আধা লিটারের কিছু কম তেল কেনেন। জমিলা বেগম বলেন, প্রতিদিন ১০ টাকা বা ২০ টাকার তেল কেনেন। এক দিনে শেষ হয়ে যায়। তাই এবার ১০০ টাকার তেল কিনেছেন।

শুল্ক ও করে আরও ছাড় দিয়ে সয়াবিন তেলের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনা যায় কি না, সরকারের সেই চেষ্টা করা উচিত বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বৈশ্বিক বাজারে ভোজ্যতেলের বড় ধরনের সংকট চলছে। কিছু দেশ রপ্তানি বন্ধ করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ছে। যার প্রভাব দেশেও পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদেরও দায়িত্ব আছে। পয়সা কামানোর জন্য তারা মজুত করলে সংকট আরও বাড়বে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ও তাদের জবাবদিহির আওতায় আনার প্রক্রিয়া সরকারকে সব সময় চালু রাখতে হবে।