বহুপক্ষীয় বাণিজ্যপদ্ধতির ধারণা নিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) জন্ম হলেও সংস্থাটি এখন ‘লাইফ সাপোর্টে’ রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, ডব্লিউটিও নিজেই নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বহুপক্ষীয় বাণিজ্যপদ্ধতি তেমনভাবে আর নেই। বাণিজ্য এখন আঞ্চলিক এবং দ্বিপক্ষীয় মুক্তবাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে চলছে। ব্যাপক হারে অর্থনৈতিক অংশীদারি চুক্তির মাধ্যমেও হচ্ছে বৈশ্বিক বাণিজ্য।
রেহমান সোবহান যুক্তরাষ্ট্রকে বহুপক্ষীয় বাণিজ্যপদ্ধতির প্রধান লঙ্ঘনকারী দেশ উল্লেখ করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনার ভিত্তিতে প্রতি দুই বা তিন সপ্তাহে চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতি ডব্লিউটিওকে সম্পূর্ণ অর্থহীন করে তোলে।
৩০ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ডব্লিউটিওর দ্বাদশ মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনের প্রাক্কালে ঢাকায় এক সংলাপে এসব কথা বলেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল এ সম্মেলনে যোগ দেবে।
আজ বৃহস্পতিবার সিপিডি ও জার্মানির সংস্থা ফ্রিডরিক-ইবার্ট স্ট্রিফটাং (এফইএস) বাংলাদেশ ‘আসন্ন ডব্লিউটিওর দ্বাদশ মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন: বাংলাদেশের প্রত্যাশা ও বাংলাদেশের অবস্থান’ শীর্ষক এই সংলাপের আয়োজন করে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অ্যাপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর সঞ্চালনায় সংলাপে সভাপতিত্ব করেন রেহমান সোবহান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
সংলাপে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক, উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান ও ইউএনডিপির দেশীয় অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ, সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও এফইএস বাংলাদেশের কর্মসূচি সমন্বয়কারী সাধন কুমার দাস।
রেহমান সোবহান বলেন, ডব্লিউটিওর হংকং মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে উন্নত দেশগুলো এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর জন্য শুল্কমুক্ত বাজার প্রবেশাধিকার দিতে রাজি হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র তা মানেনি। ৯৭ শতাংশ পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার থাকলেও বাংলাদেশি পোশাককে রাখা হয় এর বাইরে।
স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে সত্যিকার অর্থে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে হলে বাংলাদেশকে বৈশ্বিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক হতে হবে বলে মনে করেন রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, বৈশ্বিক বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিষয় হচ্ছে শ্রম অধিকার, মানবাধিকার এবং প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচনী ব্যবস্থা। তাঁর প্রশ্ন, এসব বিষয়ে কতটা উত্তরণ ঘটছে বাংলাদেশের?
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘এলডিসি থেকে প্রকৃত উত্তরণ হবে তখনই, যখন আমরা বৈশ্বিকভাবে প্রতিযোগিতাপূর্ণ দেশ হতে পারব। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা হারিয়েছে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। দুটি দেশই এখন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়ে লড়াই করছে।’
রেহমান সোবহান বলেন, বাণিজ্য আলোচনার পুরো ধারণাটি বদলে গেছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শুল্ক সুবিধার এক বছর বা তিন বছর বাড়ানোর দাবি করাও অযৌক্তিক। বাংলাদেশকে এলডিসি গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের প্রথম ডেপুটি চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামকে শুরুর দিকে ব্যাপক তর্ক করতে হয়েছে বলেও স্মরণ করেন রেহমান সোবহান।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বলেন, আন্তর্জাতিক ক্রেতারা স্থানীয় ব্যাংকগুলো থেকে ঋণপত্র (এলসি) নিতে চায় না। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে ব্যাংকের এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও ভালো হবে।
মূল প্রবন্ধে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে এতদিন ছিল—বাংলাদেশ শুধু পাবে। ২০২৬ সালের পর থেকে বাংলাদেশকে দিতেও হবে। তারপরও দেখতে হবে কোন কোন জায়গা থেকে বাংলাদেশের পাওয়ার আছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির দিকে মনোযোগ বৃদ্ধি নতুন সুযোগ নিয়ে আসতে পারে।
প্রবন্ধে আরও বলা হয়, ১৯৭১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৬টি দেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটেছে। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (ইউএন-সিডিপি) এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার ব্যাপারে ২০১৮ সালে ১২টি দেশকে নির্বাচিত করেছিল। কোভিড-১৯–এর প্রভাবে ৫টি দেশ জানিয়েছে, তারা এখন পারবে না। বাকি সাতটির মধ্যে বাংলাদেশও আছে।
বিদ্যমান সুবিধাগুলো বৃদ্ধি ও নতুন সহায়তা পাওয়ার চেষ্টা করা এবং এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর নতুন অগ্রাধিকার চিহ্নিত করা, এই তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয় প্রবন্ধে। বলা হয়, এলডিসি থেকে বের হওয়ার পরও মালদ্বীপ কিছু বাড়তি সুবিধা পেয়েছিল, এটা মনে রাখতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেমন (ইইউ) তিন বছর বাড়তি সুবিধা দেবে, একই অনুরোধ ভারতকেও করা যেতে পারে।
এ ছাড়া প্রবন্ধে বাংলাদেশের করণীয় হিসেবে কয়েকটি বিষয়ে মনোযোগের পরামর্শ দেওয়া হয়। পরামর্শগুলো হচ্ছে—বাজার সুবিধা থেকে উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে যাওয়া; নগদ সহায়তা পুনর্গঠন করা; বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও পরিবহন যোগাযোগব্যবস্থাকে একসঙ্গে বিবেচনায় রাখা এবং দ্বিপক্ষীয় চুক্তির দিকে যাওয়া।