রুশ অতিধনীরা কুপোকাত

যুদ্ধ মানেই নির্বিচার হামলা, বেপরোয়া ধ্বংসযজ্ঞ এবং পাল্টা প্রতিরোধ। সব যুদ্ধেরই চূড়ান্ত পরিণতি জানমালের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি। তবে যুদ্ধের দামামা বাজলে অতিধনীরাও ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েন। সেটি দেখা যাচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে। বিশেষ করে রাশিয়ার শীর্ষ ধনীরা যুদ্ধের কারণে ইতিমধ্যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ হারিয়েছেন।

রাশিয়ার রাজনৈতিকভাবে প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী অতিধনীরা সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় বিপুল পরিমাণ সম্পদ খুইয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা জারি ও রাশিয়ান মুদ্রা রুবলের দরপতনের কারণে সেই দেশের অতিধনীরা ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এ নিয়ে অবশ্য নানা রকম তথ্য দিচ্ছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো।

সিএনবিসি বলেছে, যুদ্ধের দামামা বাজতেই রুশ অতিধনীরা ৮০ বিলিয়ন তথা ৮ হাজার কোটি ডলারের সম্পদ খুইয়েছেন। তাঁদের এই ক্ষতি বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার মতো (প্রতি ডলার ৯০ টাকা ধরে)। ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী, এই ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ৮ হাজার ৮০০ কোটি ডলার বা ৭ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা। আবার যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিন জানিয়েছে, প্রথম কয়েক দিনেই রাশিয়ার ১১৬ জন অতিধনী ১২ হাজার ৬০০ কোটি ডলার বা ১১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকার সম্পদ খুইয়েছেন। এর মধ্যে ইউক্রেনে রুশ হামলার প্রথম দিনেই প্রায় ৭ হাজার ১০০ কোটি ডলার কমেছে। ওই দিন রাশিয়ার শেয়ারবাজারের প্রধান মায়েক্স ৩৩ শতাংশ কমেছে। এ ছাড়া মার্কিন ডলারের বিপরীতে রুশ মুদ্রা রুবেলের দাম কমে রেকর্ড নিম্ন পর্যায়ে নেমে যায়।

যুদ্ধের পরিস্থিতিতে রুশ ধনকুবেরদের বিলাসবহুল কয়েকটি প্রমোদতরি জব্দ করেছে পশ্চিমা দেশগুলো। এর মধ্যে উজবেক বংশোদ্ভূত রুশ ধনকুবের আলিশার উসমানভের ৫০০ ফুট দৈর্ঘ্যের ‘দিলবার’, যুক্তরাজ্যের চেলসি ফুটবল ক্লাবের মালিক রোমান আব্রামোভিচের ৪৬০ ফুট দৈর্ঘ্যের ‘সোলারিচ’ ও রোজনেফট তেল কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইগর সেচিনের ২৮০ ফুটের ‘আমোর ভেলো’ নামের তিনটি প্রমোদতরি রয়েছে।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করায় এর জেরে পশ্চিমা বিশ্ব একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে চলেছে। এ কারণে দেশটিতে অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। মনে করা হচ্ছে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা তার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিতে পারে। কারণ, পশ্চিমারা রাশিয়ার পাশাপাশি দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ অতিধনীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে রাশিয়ার শীর্ষস্থানীয় ২০ জন বিলিয়নিয়ার, তথা অতিধনীর সম্পদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ খোয়া গেছে। প্রসঙ্গত, ১০০ কোটি মার্কিন ডলার বা এর চেয়ে বেশি পরিমাণ ধনসম্পদের মালিকদের বিলিয়নিয়ার বলা হয়।

পশ্চিমা দেশগুলো নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে রাশিয়ান ধনীদের সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তারা রুশ অতিধনীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার লক্ষ্যে একটি নতুন বৈশ্বিক টাস্কফোর্স গঠনের কথাও জানিয়েছে।

রুশ বিশেষজ্ঞরাও ইতিমধ্যে স্বীকার করে নিয়েছেন যে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আর্থিক প্রভাব শুরু হয়েছে।

রাশিয়ার শীর্ষস্থানীয় তেল কোম্পানি লুকঅয়েলের প্রেসিডেন্ট ভ্যাগিত আলেকপেরভ সবচেয়ে বেশি সম্পদ হারিয়েছেন। ৬০ শতাংশ সম্পদ খোয়ানোর কারণে তিনি ব্লুমবার্গের বিলিয়নিয়ার ইনডেক্স তথা তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। আজারবাইজানি বংশোদ্ভূত এই ধনকুবের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে ১ হাজার ৫০ কোটি ডলারের সম্পদ হারিয়েছেন। তিনি ফোর্বস–এর বিলিয়নিয়ার তালিকায় ৬৬তম স্থানে রয়েছেন।

যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ভ্লাদিমির পোটানিনের সম্পদের প্রায় এক–চতুর্থাংশই খোয়া গেছে। তাঁর সম্পদ কমে এখন ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। তিনি ফোর্বসের তালিকায় ৫৫তম ধনী।

রাশিয়ার মেগাফোন, ইউএসএম হোল্ডিংস ও উদোকান কপারের মালিক উসমানভের সম্পদের পরিমাণ ১৭০ কোটি ডলার কমে ১ হাজার ৯৫০ কোটি ডলারে নেমে গেছে। তিনি ফোর্বস–এর বৈশ্বিক ধনী তালিকায় ৯৯তম স্থানে রয়েছেন।

রাশিয়ার অতিধনীদের আরও অনেকেই চরমভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তেমনই একজন ভলগা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এবং গ্যাস কোম্পানি নোভেটেক ও সিবুর হোল্ডিংয়ের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য গেনাদি টিমচেঙ্কো। তাঁর সম্পদ ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার থেকে রীতিমতো অর্ধেক কমে ১ হাজার ১০০ কোটি ডলারে নেমে গেছে। ফোর্বস–এর তালিকায় তিনি ৭৮তম স্থানে আছেন। একই সঙ্গে নোভাটেকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) লিওনিদ মিখেলসনের সম্পদও ১ হাজার ৫০ কোটি ডলার কমে ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার হয়েছে।

অন্যান্য অতিধনীর মধ্যে রুশ ‘খনি-ম্যাগনেট’খ্যাত আলেক্সি মোর্দাশভের সম্পদের পরিমাণ ৫৬০ কোটি ডলার কমে ২ হাজর ২০০ কোটি ডলারে নেমেছে। ফোর্বস-এর ইনডেক্সে তাঁর নাম রয়েছে ৫১তম স্থানে।

যুক্তরাজ্যের চেলসি ফুটবল ক্লাবের মালিক ও রুশ ধনকুবের রোমান আব্রামোভিচ প্রায় ২০০ কোটি ডলারের সম্পদ খুইয়েছেন। এর মধ্যে তাঁর ৪৬০ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি সুপার ইয়ট রয়েছে, যেটির দাম ৬০ কোটি ডলার। স্পেনের একটি শিপইয়ার্ড থেকে ইয়টটি জব্দ করা হয়। সেটি ২০২১ সালে মেরামতের জন্য সেখানে নেওয়া হয়েছিল। তিনি এখন বিশ্বের ১৪২তম অতিধনী।

রাশিয়ার বহুজাতিক শিল্পগোষ্ঠী আলফা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মিখাইল ফ্রিডম্যান ২৩০ কোটি ডলারের সম্পদ খুইয়েছেন। ফোর্বস ম্যাগাজিনের তালিকা অনুযায়ী মিখাইল ফ্রিডম্যান এখন বিশ্বের ১২৮তম ধনী।

এদিকে প্রতিবছর বিলিয়নিয়ারদের বৈশ্বিক তালিকা প্রকাশ করে ব্যাপক সুখ্যাতি পাওয়া মার্কিন ম্যাগাজিন ফোর্বস একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। তা হলো তাদের বিলিয়নিয়ার তালিকা থেকে গত কয়েক সপ্তাহে রাশিয়ার অন্তত এক ডজন অতিধনীর নাম বাদ পড়েছে। অর্থাৎ এসব অতিধনীর সম্পদের পরিমাণ কমে ১০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে গেছে।