শাহেদের কারখানায় তৈরি হয় ভারী যন্ত্র

বুয়েটে যন্ত্র প্রকৌশল বিষয়ে পড়ালেখা শেষে গ্যাটকোর প্রোডাক্ট সাপোর্ট সেলস ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন মো. শাহেদ হাসান। এক বছর পর তা ছেড়ে তিনি বিওসিতে যোগ দেন। তিন বছর পর সেই চাকরিও ছেড়ে দিয়ে নিজস্ব ব্যবসা খোলেন। এখন তার কারখানায় কুলিং টাওয়ারসহ বিভিন্ন যন্ত্র তৈরি হয়। আগামী বছর গাড়ির যন্ত্রাংশ ও কৃষিযন্ত্র তৈরির স্বপ্ন দেখছে তার কোম্পানি।

মো. শাহেদ হাসান

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে তিনি বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রের নকশা বানাতে চাইতেন। তখন অবশ্য ব্যবসায়ের চিন্তা ছিল না তাঁর মাথায়। যন্ত্র বানানো ও নকশা তৈরির নেশাই ধীরে ধীরে তাঁকে ব্যবসায়ের দিকে নিয়ে আসে। এতেই তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন।

বলা হচ্ছে, কুলিং টাওয়ার নির্মাণ খাতের ব্যবসায়ী মো. শাহেদ হাসানের কথা। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে তিনি নিজের উদ্যোক্তা জীবনের গল্প তুলে ধরেন। বর্ণনা করেন এই পথে আসার ক্ষেত্রে নানা চড়াই-উতরাইয়ের কাহিনি।

২০০৭ সালে প্রথম ঢাকার মিরপুরে মাত্র ৯ জন কর্মী নিয়ে কুলিং টাওয়ার বানাতে শুরু করেন। আর্টিজান ক্র্যাফট (বিডি) লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এক দশকের মধ্যেই এখন সেই প্রতিষ্ঠানে ৫০ জন কর্মী কাজ করছেন। হালকা শিল্পের পাশাপাশি মনযোগ দিচ্ছেন ভারী শিল্পের যন্ত্র নির্মাণের দিকেও। তবে এই যাত্রার শুরুটা ছিল অন্যরকম।

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে যন্ত্র প্রকৌশল বিষয়ে অধ্যয়ন করেন শাহেদ হাসান। তিনি জানান, একাডেমিক পড়াশোনায় তাঁর খুব বেশি মনোযোগ ছিল না। তবে তাপবিদ্যার যান্ত্রিক বিষয়গুলোতে বেশ আগ্রহ ছিল তাঁর। স্নাতকে থাকা অবস্থায় এক অধ্যাপকের সহায়তায় ব্যবহারিক কাজের অংশ হিসেবে প্রথম একটি পরিমাপক যন্ত্র বানান তিনি। শাহেদ বলেন, ‘কাজটিতে সফল হওয়ায় আমার মধ্যে যন্ত্র বানানোর আগ্রহ তৈরি হয়। এরপর পড়াশোনার অংশ হিসেবে বেশ কিছু কাজ করলেও মূল উদ্যোগ শুরু করি আরও কয়েক বছর পরে।’

শাহেদ হাসান জানান, স্নাতক শেষে তিনি যন্ত্র প্রকৌশল খাতের চাকরিই খুঁজছিলেন। কিন্তু চাকরি মেলে ছয় মাস পর, গ্যাটকোর প্রোডাক্ট সাপোর্ট সেলস ইঞ্জিনিয়ার। সেখানে বছরখানেক চাকরি করার পর যোগ দেন শিল্প খাতে অক্সিজেন সরবরাহকারী বহুজাতিক ব্রিটিশ অক্সিজেন কোম্পানিতে (বিওসি), যেটি এখন লিনডে বাংলাদেশ নামে পরিচিত। তবে বিওসিতে প্রকৌশলী হিসেবে নয়, দায়িত্ব পান কাস্টমার রিলেশন কর্মকর্তা হিসেবে। শুরুতে ভালো লাগলেও একসময় বুঝতে পারেন, এটি তাঁর পছন্দের জায়গা নয়। তাই বছর তিনেক পরে হঠাৎ ছেড়ে দেন সেই চাকরি।

‘এখন আমি ব্যবসায়ের পরিধি বাড়াতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছি। পাশাপাশি বিদেশেও পণ্য রপ্তানির চেষ্টা করছি। দাম ও মান পর্যালোচনা করে দেখেছি, দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে আমি চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারব বলে মনে হচ্ছে।’
শাহেদ হাসান, কুলিং টাওয়ার নির্মাণ খাতের ব্যবসায়ী

যন্ত্র প্রকৌশলী শাহেদ হাসান জানান, ছোটবেলা থেকে ঢাকায় বেড়ে উঠলেও বিওসিতে (বর্তমানে লিনডে বাংলাদেশ) তাঁর প্রথম কর্মস্থল হয় পাবনাতে। চাকরির সুবাদে ঘুরতে হয় জেলার প্রত্যন্ত সব এলাকায়। এ সময় স্থানীয় তথা দেশি প্রযুক্তি নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয় তাঁর। শাহেদ বলেন, ‘আমার মনে হলো, স্থানীয় মানুষের প্রয়োজন বুঝে যন্ত্র বানালে তাতে বেশি কার্যকর ফল পাওয়া যাবে। সেখান থেকেই দেশি প্রযুক্তিতে স্থানীয় উপযোগী যন্ত্র বানানোর চিন্তাভাবনা শুরু করি আমি। পাশাপাশি করপোরেট কালচার, বিশেষ করে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে জানতে পারি বিওসিতে চাকরি করার সুবাদে। এসব অভিজ্ঞতাও এখন আমার কাজে লাগছে।’

কিন্তু হঠাৎ চাকরি ছাড়লেও একা একা নতুন ব্যবসায়ের উদ্যোগ নিতে পারছিলেন না শাহেদ। কয়েকজনকে বললেও কেউ রাজি হননি সে সময়। শাহেদ বলেন, ‘যন্ত্র বানানোর নেশা থেকে তখন অস্থায়ী ভিত্তিতে যেখানে যে কাজ পেয়েছি, তা–ই করেছি। অনেক বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যেও সে সময় আমার মা ও খালা অনেক সহায়তা করেছেন আমাকে। প্রায় এক বছর পরে, ২০০৭ সালে এক শুভাকাঙ্ক্ষী আমাকে পাওয়ার প্ল্যান্টে কুলিং টাওয়ার সরবরাহের ব্যবসা করার পরামর্শ দেন।’

আশুলিয়ায় আটিজান ক্র্যাফটের কারখানায় কুলিং টাওয়ার তৈরির কাজ করছেন কর্মীরা।

কুলিং টাওয়ার মূলত কারখানার যন্ত্র থেকে উদ্ভূত অতিরিক্ত তাপ নিয়ন্ত্রণের কাজ করে। এরপর এটা নিয়ে কিছুদিন প্রাথমিক পড়াশোনা করে বিদেশি একটি কোম্পানির এ দেশীয় বিক্রয় প্রতিনিধির কাজ নেন তিনি। কিন্তু নতুন কোম্পানি হওয়ায় কুলিং যন্ত্র বিক্রি করতে গিয়ে গ্রাহক সংকটে পড়েন তিনি। প্রায় ১০ মাস পরে প্রথম যন্ত্রটি বিক্রি হয় তাঁর। সেটি নেওয়া হয় সায়েদাবাদের একটি ওয়াটার প্ল্যান্টের জন্য।

শাহেদ বলেন, ‘কুলিং টাওয়ার স্থাপনের (ইনস্টলেশন) প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে জানতাম। কিন্তু প্রথমবার স্থাপন করতে গিয়ে হাতেকলমে সব অভিজ্ঞতা হয় আমার। তখন মনে হয়েছে, এ ধরনের যন্ত্র তো নিজেই বানাতে পারি। এরপর শুরু হয় নতুন চেষ্টা। পুরো প্রক্রিয়া জানতে আবার পড়াশোনা শুরু করি। ওই বছরেই ঢাকার মিরপুরে নিজের বাসার নিচে গ্যারেজের জায়গায় মিস্ত্রি ও অন্যান্য জিনিস এনে কুলিং টাওয়ারের যন্ত্রাংশ বানানোর কাজে হাত দিই। নিজের কোম্পানির নামে নিবন্ধন নিই। ক্রমে কাজ বাড়তে থাকে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় বছরখানেক পরে মিরপুরেই টিনের একটি ঘর ভাড়া করি।’

প্রথমে কুলিং টাওয়ারের যন্ত্রাংশ বানানোর কাজ শুরু করলেও পরে পুরো যন্ত্রটিই বানানোর দিকে মনোনিবেশ করেন শাহেদ। তিনি বলেন, ‘আস্তে আস্তে আমার কাজের দক্ষতা বাড়ে, একই সঙ্গে বাড়ে কাজের মানও। তবে শুরু থেকেই ‘‘মেড ইন বাংলাদেশ’’ ধারণা নিয়ে এগোতে থাকি। তখন গ্রাহকের আস্থা পেতে অনেক কষ্ট হতো। কিন্তু একপর্যায়ে সে অবস্থা কেটে যায়। এখন গ্রাহকেরাই আমাকে খুঁজে নেন। দেশের বাজারে ছোট শিল্পকারখানা থেকে শুরু করে বৃহৎ কারখানাও আছে আমার গ্রাহকের তালিকায়। বর্তমানে কুলিং টাওয়ার ও এর যন্ত্রাংশ ছাড়াও হেভি ডিউটি ভেন্টিলেশন ফ্যান, ইন্ডাস্ট্রিয়াল চিলার ও আইস মেশিন বানাই।’ এসব যন্ত্রপাতি বিক্রি করে বছরে এখন সাত থেকে আট কোটি টাকা আয় হয় বলে জানান শাহেদ।

মো. শাহেদ হাসান জানান, করোনার সময়ে বেশ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়লেও এখন তা কাটিয়ে উঠেছেন। কোম্পানি নিয়ে বেশ কিছু ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। বলেন, ‘আরও মানসম্মত পণ্য বানানোর জন্য শ্রমঘন শিল্প থেকে যন্ত্রনির্ভর শিল্পে যাওয়ার চেষ্টা করছি। এ ছাড়া আগামী বছরের মধ্যে অটোমোবাইল বা গাড়ির যন্ত্রাংশ ও বেশ কিছু কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরির পরিকল্পনা আছে আমার। পাশাপাশি আমি গবেষণাতেও প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করছি।’

উদ্যোক্তা থেকে ব্যবসায়ী হওয়া শাহেদ হাসান বলেন, ‘এখন আমি ব্যবসায়ের পরিধি বাড়াতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছি। পাশাপাশি বিদেশেও পণ্য রপ্তানির চেষ্টা করছি। দাম ও মান পর্যালোচনা করে দেখেছি, দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে আমি চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারব বলে মনে হচ্ছে।’

নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য শাহেদের পরামর্শ হলো, পণ্যের মান সম্পর্কে যত্নবান হতে হবে। বলেন, ‘পণ্য যা-ই হোক, মান বজায় রেখে একটা স্বাতন্ত্র্য রাখতেই হবে। খুব বেশি চিন্তা না করে মাঠে নেমে যেতে হবে। ধৈর্যসহকারে ছুটতে হবে স্বপ্নের পেছনে। তবেই মিলবে সফলতা।’