শিল্পের সাম্রাজ্যে টি কে গ্রুপের ৫০ বছর

৫০ বছরে পা রেখেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান টি কে গ্রুপ। দুই ভাইয়ের হাত ধরে এ গ্রুপের যাত্রা শুরু হয় ১৯৭২ সালে। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ভোগ্যপণ্য আমদানির মধ্য দিয়ে ব্যবসা শুরু করা গ্রুপটির কারখানা এখন ৪৩টি। এবােরর মূল প্রতিবেদন টি কে গ্রুপ নিয়ে।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে টি কে গ্রুপের ঢেউটিনের কারখানা
ছবি: টি কে গ্রুপের সৌজন্যে

৯৮৩ সাল। সময়টি ছিল শর্ষে তেলের যুগ। সয়াবিন তেল সবে জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। সে সময় সয়াবিন তেল আমদানি হতো পরিশোধিত আকারে। শর্ষে তেলের দাপটের ওই সময়ে দেশে সয়াবিন তেল পরিশোধনের কারখানা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন দুই ভাই। সরকার থেকে লাইসেন্স বা নিবন্ধন নিয়ে কালুরঘাটে গড়ে তোলেন টি কে অয়েল রিফাইনারি। বাংলাদেশে শিল্পায়ন শুরুর প্রথম ধাপে এই কারখানা সাফল্য এনে দেয় দুই ভাইকে।

এরপর দুই সহোদরের হাত ধরে একে একে গড়ে ওঠে শিল্পকারখানা। যে দুই ভাইয়ের হাত ধরে এই গ্রুপ গড়ে উঠেছে, তাঁরা হলেন মোহাম্মদ আবু তৈয়ব ও মোহাম্মদ আবুল কালাম। দুই ভাইয়ের নামের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি হয় টি কে (তৈয়ব-কালাম) গ্রুপ। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত টি কে গ্রুপ এ বছর ৫০ বছরে পা দিয়েছে।

মোহাম্মদ আবু তৈয়ব

শুধু ভোজ্যতেল পরিশোধনের কারখানাই নয়, টি কে গ্রুপের হাতে দেশে প্রথম গড়ে উঠেছে এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কারখানা—টি কে গ্যাস অ্যান্ড গ্যাস সিলিন্ডার। বাঙালি উদ্যোক্তার হাতে গড়ে ওঠা প্রথম পার্টিকেল বোর্ডের ইতিহাসও লেখা টি কে গ্রুপের। সেটি ১৯৮৮ সালে। সিমেন্ট ও খাদ্যশস্য রাখার পিপি ব্যাগের কারখানা চালু হয়েছে এই গ্রুপের হাত ধরে। ঢেউটিনের কারখানায়ও শুরুর দিকে ছিল টি কে গ্রুপ। আবার সোয়েটার তৈরির জন্য বাংলাদেশে অ্যাক্রেলিক সুতা তৈরির প্রথম কারখানাও গড়ে তুলেছিল গ্রুপটি। এ রকম বহু কারখানার ক্ষেত্রে প্রথম পথ দেখিয়েছে গ্রুপটি। তাতে ৫০ বছর শেষে গ্রুপটির এখন উৎপাদনমুখী কারখানার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৩টিতে।

এসব কারখানায় ৪০০টির বেশি ইউনিটে দিন-রাত চলছে পণ্য উৎপাদন। গ্রুপটিতে প্রত্যক্ষভাবে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫০ হাজারের বেশি মানুষের। গ্রুপটির বার্ষিক টার্নওভার ১৮ হাজার কোটি টাকা। সহযোগী প্রতিষ্ঠানের হিসাব ধরা হলে টার্নওভারের পরিমাণ আরও বাড়বে। গ্রুপটি প্রতিবছর সরকারকে বিপুল পরিমাণ রাজস্বও দিচ্ছে।

টি কে গ্রুপের অর্ধশতক বছরের সাফল্যের নেপথ্যে আছে উদ্যোক্তাদের কঠোর পরিশ্রম ও সততা। ঋণখেলাপির এই যুগেও গ্রুপটির কোনো ব্যাংক চেক কখনো প্রত্যাখ্যাত হয়নি। আবার ব্যবসায়িক অঙ্গীকারও বরখেলাপ করেনি গ্রুপটি। গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবুল কালাম শুরু থেকেই এই দুটি বিষয়কে গ্রুপের মূলনীতি হিসেবে বাস্তবায়ন করেছেন। তাতে আজকের এই অবস্থানে এসেছে গ্রুপটি।

একটি উদাহরণ দিলেই হয়তো বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। ২০০৮ সালে বিদেশি সরবরাহকারীর সঙ্গে ১ হাজার ৪০০ ডলারে সয়াবিন তেল আমদানির চুক্তি হয়েছিল টি কে গ্রুপের। কয়েকটি চালানের চুক্তির পর সয়াবিন তেলের দাম অর্ধেক হয়ে যায়। সে সময় আমদানিকারক দেশগুলোর অনেকেই পিছুটান দিয়েছিল। তবে লোকসান হবে জেনেও ঋণপত্র খুলেছেন মোহাম্মদ আবুল কালাম। লোকসান দিয়ে অঙ্গীকার রক্ষা করেছেন।

বাণিজ্য থেকে প্রথম কারখানা

মোহাম্মদ আবু তৈয়ব ও মোহাম্মদ আবুল কালামের বাবা মীর আহমেদ সওদাগর একসময় মিয়ানমারের রেঙ্গুনে (বর্তমানে ইয়াঙ্গুন) ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। সেখান থেকে চট্টগ্রামের চাক্তাই ফিরে আসেন। প্রথমে সেখানে দোকান খোলেন। এরপর ১৯৭২ সালে তাঁর ছেলে মোহাম্মদ আবুল কালামকে এক হাজার কেজি ধান বিক্রির টাকা দেন ব্যবসার জন্য। ধান বিক্রির ১ হাজার ৮০০ টাকা হাতে নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন আবুল কালাম। ধীরে ধীরে খাদ্যশস্যের সঙ্গে বাণিজ্যের তালিকায় যুক্ত হয় ভোজ্যতেল ও মসলা। সঙ্গে ছিলেন বড় ভাই মোহাম্মদ আবু তৈয়ব।

বাবা সাফল্য না পেলেও দুই সন্তান খাতুনগঞ্জে ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ে লাভের মুখ দেখেন। প্রায় এক দশক ধরে ভোজ্যতেল আর মসলা বাণিজ্যে বেশ লাভ হয়। লাভের দেখা মিললেও শুধু বাণিজ্যে মন বসেনি দুই ভাইয়ের। তাই কারখানা গড়ে তোলার চিন্তা আসে তাঁদের। সেই চিন্তা থেকেই ১৯৮৩ সালে সয়াবিন পরিশোধনের কারখানা গড়ে তোলার লাইসেন্স নেন। লাইসেন্স পেয়ে ১০০ টন পরিশোধনক্ষমতার কারখানা গড়ে তোলে টি কে গ্রুপ। সে সময় ১৫০ জন কর্মী নিয়ে কালুরঘাটে যাত্রা শুরু হয় টি কে অয়েল রিফাইনারির। বেসরকারি খাতে এ দেশের উদ্যোক্তাদের হাতে গড়ে ওঠা বড় আকারের প্রথম কারখানা ছিল এটি।

কারখানা শুরুর গল্পটা শোনা যাক গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবুল কালামের কাছেই। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে উৎপাদন হওয়ায় শর্ষে তেল ছিল সে সময় বেশ সহজলভ্য। তবে স্বাধীনতার পর রান্নায় বিকল্প তেল হিসেবে সয়াবিন তেলের ব্যবহার ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে। ওই সময় সরাসরি পরিশোধিত
আকারে সয়াবিন তেল আমদানি হতো। পরে চাহিদা বাড়তে শুরু করলে আমরা কারখানা করার উদ্যোগ নিই।’

টি কের হাতে শিল্প খাতের নেতৃত্ব

মোহাম্মদ আবুল কালাম

সয়াবিন পরিশোধনের কারখানায় লাভের মুখ দেখে শিল্পকারখানা গড়ে তোলার নেশা পেয়ে বসে দুই ভাইকে। তখন শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য লাইসেন্স নিতে হতো। সয়াবিন পরিশোধনের কারখানার পর কাছাকাছি সময়ে রড তৈরির কারখানা গড়ে তোলেন তাঁরা। টি কে রি-রোলিং মিলস নামের কারখানাটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৩ সালে। অবশ্য পরে রড কারখানায় থাকেনি গ্রুপটি। রডের পরিবর্তে ঢেউটিনে বিনিয়োগ করে তারা। ১৯৮৭ সালে ফৌজদারহাটে গড়ে তোলা হয় ঢেউটিন তৈরির কারখানা এনআর স্টিল গ্যালভানাইজিং। বর্তমানে গ্রুপের দুটি কারখানায় ঢেউটিন উৎপাদন হচ্ছে। ঈগল ব্র্যান্ডের নামে তা বাজারজাত করছে গ্রুপটি।

১৯৮০–এর দশকে কাঠের বিকল্প পরিবেশবান্ধব পার্টিকেল বোর্ড খুব জনপ্রিয় ছিল না। তবে পার্টিকেল বোর্ড সামনে বাজার দখল করবে, এমন চিন্তা থেকে গ্রুপের উদ্যোক্তারা কালুরঘাটে গড়ে তোলেন টি কে পার্টিকেল বোর্ড মিলস। ওই সময় অবাঙালি উদ্যোক্তার হাতে গড়ে ওঠা একটি কারখানা ছিল পার্টিকেল বোর্ডের। টি কে কারখানা করার পর থেকে এখন পর্যন্ত পার্টিকেল বোর্ডে নেতৃত্ব দিচ্ছে টি কের সুপার বোর্ড। দেশে মোট পার্টিকেল বোর্ডের এক–চতুর্থাংশের বেশি উৎপাদিত হচ্ছে এই গ্রুপের কারখানায়। আসবাবশিল্পের এই কাঁচামালে আমদানিনির্ভরতা কমিয়েছে গ্রুপটি।

তিন দশক আগেও দেশে এলপিজির ব্যবহার ছিল খুবই সীমিত। ইস্টার্ন রিফাইনারি থেকে সরবরাহ হতো এলপিজি। ১৯৯১ সালে এলপিজি রাখার সিলিন্ডার উৎপাদনের কারখানা গড়ে তোলে টি কে গ্রুপ। প্রতিদিন ৪০০টি সিলিন্ডার উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে কারখানাটির। এলপিজি খাতে নতুন নতুন বিনিয়োগ করছে এখন গ্রুপটি।

ভোজ্যতেল ও জ্বালানি পণ্য লুব্রিকেন্ট রাখার জন্য তিন দশক আগে ড্রাম কারখানাও গড়ে তোলে গ্রুপটি। এটি ছিল বাংলাদেশে প্রথম ড্রাম কারখানা। ১৯৯১ সালে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় চিটাগাং সিমেন্ট ক্লিংকার অ্যান্ড গ্রাইন্ডিং কারখানা। দরপত্রের মাধ্যমে ১৯৯৩ সালে টি কের হাতে আসে কারখানাটি। বাংলাদেশে সিমেন্ট শিল্পে ছাতকের পর দ্বিতীয় কারখানা ছিল সেটি, যেটি ১৯৭৩ সালে চালু হয়। কারখানাটি ২০০০ সালে হাইডেলবার্গ সিমেন্টের হাতে গেলেও বসে থাকেনি টি কে গ্রুপ। যৌথ অংশীদারত্বে প্রিমিয়ার সিমেন্ট কারখানায় বিনিয়োগ করেছে। নতুন বিনিয়োগের পর শীর্ষ পর্যায়ে উঠে এসেছিল কারখানাটির উৎপাদনক্ষমতা।

ট্যানারিশিল্পেও পথ দেখিয়েছে টি কে গ্রুপ। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত রিফ লেদার কারখানাটি চামড়া প্রক্রিয়াকরণের প্রথম ধাপ ‘ওয়েট ব্লু’ ক্যাটাগরিতে প্রথম বৈশ্বিক মানসনদ অর্জন করেছে। দুই বছর আগে চামড়া খাতের বৈশ্বিক সংগঠন লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) এই মানসনদ দেয়। সব মিলিয়ে প্রথম ধাপে ওয়েট ব্লু, দ্বিতীয় ধাপে ক্রাস্ট ও তৃতীয় ধাপে ‘ফিনিশড’—তিনটিতেই মানসনদ পায় কোম্পানিটি। এর আগে দেশের দুটি কারখানা শেষ দুই ধাপে বৈশ্বিক মানসনদ পেলেও প্রথম ধাপ বা ‘ওয়েট ব্লু’ ক্যাটাগরিতে মানসনদ অর্জন করতে পারেনি। বৈশ্বিক মানসনদ অর্জনের কারণে বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডের কাছে চামড়া রপ্তানিতে পথে খুলে যায়। আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে চামড়া রপ্তানি হচ্ছে রিফ লেদারের।

চা এখন এত জনপ্রিয় হবে, তা আড়াই দশক আগেও ভাবা যায়নি। সে সময় দেশি চায়ের উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি রপ্তানি হতো। এই খাতও চোখ এড়ায়নি টি কে গ্রুপের। ১৯৯০–এর দশকে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বারমাসিয়া চা–বাগান দিয়ে এই খাতে পথচলা শুরু হয় গ্রুপটির। এরপর যুক্ত হয় আরও দুটি বাগান। এই তিন বাগানে গত বছর ১৮ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়। পুষ্টি ব্র্যান্ড ও রাঙাপানি ব্ল্যাক টি নামে বাজারজাত হচ্ছে টি কের চা।

টেক্সটাইলে বিনিয়োগও হাতছাড়া করেনি টি কে গ্রুপ। ২০০৩ সালে সোয়েটার কারখানায় সরবরাহের জন্য অ্যাক্রিলিক সুতা তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করে গ্রুপটি। চীন হুং ফাইবার্স লিমিটেড নামের এ কারখানায় প্রতিদিন ৬২ টন বিভিন্ন ধরনের সুতা উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশে এ ধরনের কারখানা এটিই প্রথম বলে জানায় গ্রুপটি।

১৯৯১ সালে টি কে কেমিক্যাল কমপ্লেক্স নামের কাগজের কারখানা গড়ে ওঠে টি কের হাতে। এ রকম অসংখ্য শিল্প খাতে পথ দেখিয়েছে গ্রুপটি। প্রথম কারখানা চালুর পর থেকে ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত গ্রুপটির হাতে ২৫টির মতো শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে, যেগুলো বাংলাদেশের শিল্পায়নে পথ দেখিয়েছে।

ভোজ্যতেলে শীর্ষে

যে ভোজ্যতেল পরিশোধনের কারখানা দিয়ে শিল্পে হাতেখড়ি হয়েছে, সেই খাতে এখনো নিজেদের আধিপত্য ধরে রেখেছে টি কে গ্রুপ। সাড়ে তিন দশক ধরে গ্রুপটি এ খাতে সবচেয়ে বেশি নজর দিয়েছে। চাহিদা বাড়ার সঙ্গে যেমন আমদানি বাড়িয়েছে, তেমনি কারখানার সংখ্যাও বাড়িয়েছে। চট্টগ্রাম ছাড়াও ঢাকা ও খুলনায় মোট চারটি পরিশোধন কারখানা থেকে ভোজ্যতেল বাজারজাত করছে গ্রুপটি।

গত দুই দশকে ভোজ্যতেলের বাজারে শীর্ষে থেকেই অনেক প্রতিষ্ঠান ছিটকে পড়েছে। তবে বাজারের উত্থান-পতন সত্ত্বেও শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে টি কে। দেড় দশক আগের কথাই ধরি। ২০০৬-২০০৭ অর্থবছরে দেশে যত ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে, তার ২১ শতাংশ করেছে টি কে। ওই বছর আমদানিতে শীর্ষে ছিল গ্রুপটি। এরপর কখনো দ্বিতীয় বা তৃতীয় অবস্থানে নেমে গেলেও ঠিকই বাজার অংশীদারিতে শীর্ষস্থান পুনরুদ্ধার করেছে গ্রুপটি।

যেমন চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিতে শীর্ষস্থানে রয়েছে গ্রুপটি। এ সময় ১৬ লাখ ৯৭ হাজার টন সয়াবিন ও পাম তেল বাজারজাত হয়েছে। এর এক–চতুর্থাংশই বাজারজাত করেছে টি কে গ্রুপ। এই তেল আমদানিতে গ্রুপটি আমদানি ব্যয় পরিশোধ করেছে ৫২ কোটি ৪৩ লাখ ডলার বা সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর শুরু হওয়া ভোজ্যতেলের সংকট ও অনিশ্চয়তার সময়েও আমদানি অব্যাহত রেখেছে গ্রুপটি।

শুধু পরিশোধনের কারখানা নয়, নারায়ণগঞ্জে সয়াবিন বীজ মাড়াই করে তেল ও প্রাণিখাদ্য উৎপাদনের কারখানায় বিনিয়োগ করেছে গ্রুপটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান। তাতে দিন শেষে বাজারে আধিপত্য থাকবে টি কে গ্রুপেরই। ভোজ্যতেল ছাড়াও আটা-ময়দার কারখানাও গড়ে তুলেছে গ্রুপটি। পুষ্টি ব্র্যান্ড নামে ভোজ্যতেল ও আটা-ময়দা বাজারজাত করছে গ্রুপটি।

দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতেও ঘুরছে শিল্পের চাকা

বাবা-চাচার দেখানো পথ ধরে দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতেও গড়ে উঠছে শিল্পকারখানা। টি কে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবুল কালামের সন্তান মোস্তফা হায়দার প্রচলিত খাতের বাইরে রাসায়নিক ও পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পে নেতৃত্ব দিচ্ছে। দেড় দশক আগে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে রাসায়নিক উৎপাদনের কারখানা ‘সামুদা কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেড’ গড়ে তোলেন তিনি। বাংলাদেশে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ও কস্টিক সোডা খাতে পথ দেখানো কারখানাও এটি। এই কারখানা বাংলাদেশে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ ঘনত্বের হাইড্রোজেন পার অক্সাইড উৎপাদন শুরু করছে। টেক্সটাইলশিল্পে এই রাসায়নিকের ব্যবহার বেশি। উৎপাদন শুরুর পর হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রাসায়নিক পণ্যটি আমদানি থেকে রপ্তানিনির্ভর পণ্যে পরিণত হয়। বাংলাদেশের চাহিদা মিটিয়ে এই কারখানার উৎপাদিত হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। এই কারখানার পর এখন দেশে অনেকেই এই খাতে যুক্ত হয়েছেন।

কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে ডাঙ্গারচরে জ্বালানি পণ্য উৎপাদনের বেসরকারি খাতের প্রথম কারখানা সুপার পেট্রোকেমিক্যালের মালিকানা আসে দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে। গ্যাসের উপজাত কনডেনসেট ও ন্যাপথা প্রক্রিয়াজাত করে এই কারখানায় অকটেন, ডিজেল, জাইলিনসহ জ্বালানির পাশাপাশি নানা ধরনের জ্বালানি পণ্য উৎপাদন হচ্ছে।

এই দুটি কারখানা ছাড়াও দেশের দুটি বড় অর্থনৈতিক অঞ্চলে বড় বিনিয়োগে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মোস্তফা হায়দার। যেমন বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে মডার্ন সিনটেক্স টেক্সটাইল গ্রেডের প্লাস্টিক চিপস তৈরির কারখানা গড়ে তুলছে। এ প্রকল্পে বিনিয়োগ হচ্ছে ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। এ ছাড়া সামুদা ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে রাসায়নিক দ্রব্য, ভোগ্যপণ্য ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের কারখানায় প্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। এতে প্রায় দুই হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এ ছাড়া মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চলে (ধলঘাটা) টি কে গ্রুপের অপর প্রতিষ্ঠান সুপার পেট্রোকেমিক্যাল লিমিটেড ৪১০ একর ও সামুদা কেমিক্যাল কমপ্লেক্স ১০০ একর জমি নিয়েছে। সেখানে তারা কারখানা তৈরির কাজও শুরু করেছে।

টি কে গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবু তৈয়বের তিন সন্তান হাসনাত মোহাম্মদ আবু ওবায়দা, আবু সাদাত মোহাম্মদ ফয়সাল ও তালহা বিন তৈয়বের হাত ধরেও গড়ে উঠেছে নতুন নতুন শিল্পকারখানা। শতভাগ রপ্তানিমুখী ম্যাফ শুজ লিমিটেড ও ম্যাফ নিউজপ্রিন্ট কারখানা গড়ে তুলেছেন তাঁরা। বিনিয়োগ করেছেন কৃষি খাতেও। গড়ে তুলেছেন ম্যাফ ফার্মিং নামের প্রতিষ্ঠান। গত বছর ৬৫০ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করেছে ম্যাফ শুজ লিমিটেড। দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে গড়ে তোলা এসব কারখানা টি কে গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছে।

টি কে এখন

টি কে গ্রুপের উদ্যোক্তা দুই ভাইয়ের একজন মোহাম্মদ আবু তৈয়ব ২০১৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সহধর্মিণী লায়লা বিলকিস বর্তমানে গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রয়েছে অন্যতম উদ্যোক্তা মোহাম্মদ আবুল কালাম। দুই ভাইয়ের সন্তানেরা দ্বিতীয় প্রজন্ম হিসেবে পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করছেন।

উদ্যোক্তার কথা

টি কে গ্রুপের আজকের এ অবস্থানে উন্নীত হওয়ার জন্য সরকারের সহযোগিতা, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ ও ক্রেতার আস্থার কথা বললেন প্রধান উদ্যোক্তা ও গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবুল কালাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ক্রেতাদের কাছে সব সময় মানসম্মত পণ্য সরবরাহে গুরুত্ব দিয়েছে টি কে গ্রুপ। ক্রেতাদের কাছে আমাদের সব পণ্য ও সেবার গ্রহণযোগ্যতা নতুন নতুন শিল্পকারখানা স্থাপনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। সরকারের সহযোগিতা পাওয়ায় নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে পেরেছি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরও অবদান রাখতে টি কে গ্রুপ অবিরত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’

যাঁরা উদ্যোক্তা হতে চান, তাঁদের প্রতি পরামর্শ জানতে চাইলে তিনি বলেন, উদ্যোক্তা হতে চাইলে সহজে হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। যে বিষয়ে উদ্যোক্তা হতে চান, সে বিষয়ে আগে থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করে মাঠে নামতে হবে। সৎ ও পরিশ্রমের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করলে সফলতা আসবেই।

শুধু ব্যবসা নয়, গ্রুপটি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সেবা খাতে নানাভাবে মানুষকে সহযোগিতা করে আসছে। পটিয়ায় টি কে গ্রুপের গড়ে তোলা একটি হাসপাতালে বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে মানুষ। স্কুল, মেডিকেল কলেজসহ নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে গ্রুপটি।