সম্পূরক শুল্ক উঠলে ট্যারিফ কমিশনই ব্যবসায়ীদের ভরসা

এ সপ্তাহের সাক্ষাৎকার: আসন্ন ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট সামনে রেখে বাজেট এবং বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান ইকবাল খান চৌধুরী

ইকবাল খান চৌধুরী
ইকবাল খান চৌধুরী

প্রথম আলো: আগামী মাসে ঘোষণা হচ্ছে বাজেট। এবারের বাজেট কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
ইকবাল খান চৌধুরী: বাজেট প্রথমত দেশীয় শিল্পবান্ধব হতে হবে। কর্মসংস্থানবান্ধব হতে হবে। কারণ কর্মসংস্থান একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রতিবছর ১৮ থেকে ২০ লাখ লোক কাজের বাজারে প্রবেশ করছে। তাদের কর্মসংস্থান করতে হলে শিল্পের উৎপাদন বাড়াতে হবে। দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসতে হবে। আর এসব বিষয় লক্ষ্য রেখেই বাজেট প্রণয়ন করা উচিত।
প্রথম আলো: বাজেট সামনে রেখে তো ট্যারিফ কমিশন শুল্ক করহার বিষয়ে বেশ কিছু কাজ করে। সে সম্পর্কে কিছু বলুন।
ইকবাল খান চৌধুরী: ট্যারিফ কমিশন পুরো বাজেট নিয়ে কাজ করে না। আমদানি পর্যায়ে কিছু পণ্যের শুল্ক নিয়ে সুপারিশ করে। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কয়েক বছর আগে শুল্ক বৈষম্য নিয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। সেই কমিটি মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে শুল্ক নিয়ে সুপারিশ করে। এসব সুপারিশ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), শিল্প মন্ত্রণালয় এবং বিনিয়োগ বোর্ডে পাঠানো হয়। মূলত শিল্পের উন্নয়ন হয় এমন সুপারিশই আমরা করে থাকি। গত বছর ট্যারিফ কমিশন থেকে বাজেটকেন্দ্রিক যেসব সুপারিশ করা হয়েছে তার ৭০ শতাংশই গৃহীত হয়েছে। এবার আরও বেশি সুপারিশ গৃহীত হবে বলে আশা করছি।
প্রথম আলো: একটা অভিযোগ আছে, ট্যারিফ নির্ধারণে ট্যারিফ কমিশনের ভূমিকা আসলে কম, এটা করে থাকে এনবিআর। আপনি কি এর সঙ্গে একমত?
ইকবাল খান চৌধুরী: এটা ঠিক যে, সুপারিশ করা ছাড়া ট্যারিফ কমিশন চাইলেও বেশি কিছু করতে পারে না। যে আইনের অধীনে ট্যারিফ কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সেখানেই আমাদের শুধু সুপারিশ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আবার যেটুকু করার আছে, সেটাও ঠিকমতো হয় না। সম্পূরক শুল্কের কথাই ধরুন। ব্যবসায়ীদের জন্য অনেক সহজ হচ্ছে এনবিআরে গিয়ে তার পণ্যের সুরক্ষায় ওই পণ্য আমদানির ওপর সম্পূরক শুল্ক আরোপের দাবি জানানো এবং তাদের দাবিতে কাজও হয়। কিন্তু তারাই যদি ট্যারিফ কমিশনে আবেদন করেন সেই আবেদন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কাউন্টারভেইলিং কিংবা এন্টি-ডাম্পিং শুল্ক বসাতে ৮-১০ মাস লেগে যাবে। সে কারণে ব্যবসায়ীরাও ট্যারিফ কমিশনে আসেন না।
প্রথম আলো: সম্পূরক শুল্ক তো আগামী বছর থেকে থাকছে না। তাহলে তখন ব্যবসায়ীদের সুরক্ষা দেওয়া হবে কীভাবে?
ইকবাল খান চৌধুরী: ২০১৫ সালের জুলাইয়ের পর আর কোনো নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (রেগুলেটরি ডিউটি) থাকবে না। সম্পূরক শুল্কও প্রায় উঠে যাবে। বর্তমানে যেসব পণ্যে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা আছে, তার ৯৬ শতাংশেই এ শুল্ক থাকবে না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধিবিধান মোতাবেক এটা করতে হচ্ছে। এসব শুল্ক আরোপ করে দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু এই শুল্ক যখন থাকবে না তখন ব্যবসায়ীদের সুরক্ষা দেওয়ার বিধানও ডব্লিউটিও বলে দিয়েছে। তখন ব্যবসায়ীদের সুরক্ষা দিতে হবে কাউন্টারভেইলিং, এন্টি-ডাম্পিং এবং সেইফগার্ড শুল্কের মাধ্যমে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা এ বিষয়ে সচেতন নন। এই সুবিধা পেতে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে ব্যবসায়ীদের আবেদন করতে হবে। কারণ, কোনো পণ্যের ওপর কাউন্টারভেইলিং, এন্টি-ডাম্পিং কিংবা সেইফগার্ড শুল্ক আরোপ করা হলে ওই পণ্য রপ্তানিকারক দেশকে ডব্লিউটিওতে নিয়ে যেতে পারে। তখন তথ্য-প্রমাণাদি দিয়ে এ শুল্ক আরোপের যৌক্তিকতা বোঝাতে হয়। কিন্তু দেশের ব্যবসায়ীরা তথ্য দিতেও আগ্রহী থাকেন না। তাঁরা মনে করেন, ব্যবসার তথ্য দিলে আয়করের আওতায় সরকার তাঁকে ধরবে। আবার প্রতিযোগী ব্যবসায়ীরা তাঁর ব্যবসার তথ্য জেনে যাবেন। সে কারণে ব্যবসায়ীরা এখন ট্যারিফ কমিশনে না এসে এনবিআের যায়, যেন কোনোভাবে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়। কিন্তু সম্পূরক শুল্ক পুরোপুরি উঠে গেলে কাউন্টারভেইলিং, এন্টি-ডাম্পিং কিংবা সেইফগার্ড শুল্ক আরোপ ছাড়া দেশীয় শিল্পকে আর সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে না।
প্রথম আলো: ট্যারিফ কমিশন নিয়মিতই বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিচ্ছে। সরকারি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এটা কতটুকু অবদান রাখে?
ইকবাল খান চৌধুরী: সারা বছরই বিভিন্ন উপখাতে আমরা কাজ করি। সেখান থেকে আমরা যেসব সুপারিশ করি তার অনেকগুলোই সরকার বাস্তবায়ন করে থাকে। ট্যারিফ কমিশন রাবারের ওপর গবেষণা করে একটা রাবার বোর্ড গঠনের সুপারিশ করেছিল। তার ভিত্তিতেই সরকার সম্প্রতি রাবার বোর্ড গঠন করেছে।
প্রথম আলো: ট্যারিফ কমিশনের সক্ষমতা বাড়ানোর একটি প্রস্তাব কয়েক বছর ধরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে। সেটার কোনো অগ্রগতি আছে?
ইকবাল খান চৌধুরী: কয়েক দিন আগে এক বাজেট আলোচনায় অর্থমন্ত্রী ট্যারিফ কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বলা হয়, ট্যারিফ কমিশন কোনো কাজ করে না। সে দোষ কি আমাদের? আমাকে আপনি যুদ্ধে পাঠাবেন কি হাত-পা বেঁধে? আমাকে তো ক্ষমতা দিতে হবে। আমাদের প্রস্তাবটি কয়েক বছর ধরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর বাণিজ্যসচিবের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, প্রস্তাবের অনেক কিছুই বাস্তবসম্মত না। আমি বলেছি, যেগুলো বাস্তবসম্মত সেগুলো বাস্তবায়ন করেন। তিনি আমাকে আরেকটি প্রস্তাব পাঠাতে বলেছেন। এ ছাড়া ভবিষ্যতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আরও জোরদার হবে। তখন বাণিজ্যসম্পর্কিত আরও গবেষণামূলক কাজ করতে হবে। ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিঘ্নমুক্ত রাখতে ট্যারিফ কমিশনকে শক্তিশালী করার বিকল্প নেই।
[সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবুল হাসনাত]