সম্ভাবনাময় খাতটিতে ধীরে এগোচ্ছে বাংলাদেশ

১৯৫৭ সাল। গ্রীষ্মের সকাল। সান ফ্রান্সিসকোর ক্লিফ্ট হোটেলে একে একে জড়ো হলেন আটজন বিজ্ঞানী। সবাই তুখোড়। যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশেষ ক্ষেত্রের সেরা বিজ্ঞানীও বটে। নিজেরা ছাড়া কেউ এই মিটিংয়ের বিষয়ে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত জানেন না। তারপরও সবাই একটু নার্ভাস। কারণ, স্বপ্নপূরণের পথে পা বাড়ালে প্রতি মাসের নিশ্চিত বেতনটা হাতছাড়া হয়ে যাবে। তবে কফির কাপে চুমুক দেওয়ার সময় তাঁরা জানতেন, এক অপার সম্ভাবনার কথা।

আটজনই সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য কাজ করেন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী উইলিয়াম শকলির প্রতিষ্ঠিত শকলি সেমিকন্ডাক্টরে। শকলি বিজ্ঞানী হিসেবে অত্যন্ত মেধাবী হলেও ব্যবস্থাপক হিসেবে মোটেই সুবিধার নন—অস্থির, কাউকে বিশ্বাস করেন না, বদমেজাজি। আট তুখোড় বিজ্ঞানী তাই বিরক্ত, হতাশ ও সংক্ষুব্ধ।

ফল, সদ্য বিবাহিত এমআইটি গ্র্যাজুয়েট রবার্ট নয়েসের নেতৃত্বে নতুন একটি কোম্পানির আত্মপ্রকাশ। এ নিয়ে টম ওলফ তাঁর বিখ্যাত এসকয়ার (Esquire) বইয়ে লিখেছেন, ‘তাঁরা বুঝতে পারলেন ব্যবসার জন্য প্রচলিত সম্পদ বা কারখানা, যন্ত্রপাতি বা কাঁচামাল বলতে যা বোঝায়, সেটি এখানে নেই। তাঁদের দরকার শুধু বড় একটা কাজের টেবিল। যন্ত্রপাতি বলতে দরকার কিছু ক্লিনস, গগলস, আণুবীক্ষণযন্ত্র, টুইজার ও হীরক কাটার। কাঁচামাল হলো সিলিকন (বালি) ও জার্মেনিয়াম, যা বালু আর কয়লা থেকে আসবে। এখানে মস্তিষ্কের শক্তিই হলো আসল ফ্র্যাঞ্চাইজ’।

আট বিজ্ঞানীর কাছে চুক্তি করার মতো কোনো কাগজপত্র ছিল না। ১৯৫৭ সালের জুন মাসের সকালে তাই তাঁরা একটি ১ ডলারের নোটের ওপর সই করলেন—রবার্ট নয়েস, জুলিয়াস ব্ল্যাংক, ভিক্টর গ্রিনিচ, জিন হোয়েরনি, ইউজিন ক্লেইনার, জে লাস্ট, গর্ডন মুর ওবং শেলডন রবার্ট। ফেয়ারচাইল্ডের টাকা দিয়ে আট উদ্যমী প্রতিষ্ঠা করলেন ফেয়ারচাইল্ড সেমিকন্ডাক্টর। শকলির প্রতিষ্ঠান থেকে মাত্র ১২ ব্লক দূরে।

‘সিলিকন ভ্যালি স্টার্টআপ’ শব্দ চালু হওয়ার কয়েক যুগ আগে, ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেন ভিউ এলাকা নতুন ও উদ্ভাবনী আইডিয়ার বৈশ্বিক রাজধানী হওয়ার অনেক আগেই তাঁরা শুধু একটি নতুন কোম্পানিই সৃষ্টি করলেন না, বরং নতুন এক সংস্কৃতির সূচনা করলেন। আর ধীরে ধীরে সেখানে দানা বাঁধল এক নতুন দুনিয়ার। প্রচলিত জার্মেনিয়ামের বদলে তাঁরা সিলিকন (বালুর উপাদান) দিয়ে তাঁদের নতুন জগতের সূচনা করলেন।

এদিকে বিক্ষুব্ধ শকলি তাঁদের নাম দিলেন—‘বিশ্বাসঘাতক আট’। অন্যদিকে সেই আটজন বিজ্ঞানীর হাত ধরে চেতনা ও সৃজনশীল সম্পদের এক নতুন বিপ্লবের সূচনা হয়ে গেল।

টম ওলফ তাঁর বিখ্যাত এসকয়ার (Esquire) বইয়ে লিখেছেন, ‘তাঁরা বুঝতে পারলেন ব্যবসার জন্য প্রচলিত সম্পদ বা কারখানা, যন্ত্রপাতি বা কাঁচামাল বলতে যা বোঝায়, সেটি এখানে নেই।

প্রতিজনের জন্য ৫০টি চিপস

সেই ঘটনার মাত্র ৬৫ বছর পর এখন ইলেকট্রনিকস সার্কিট, ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (আইসি) ও চিপ (Chip) ছাড়া দুনিয়া অচল। স্মার্টফোন থেকে ইন্টারনেট, গাড়ি থেকে কাপড় ধোয়ার মেশিন, ফ্রিজ থেকে তালি দিয়ে বাতি নেভানোর ব্যবস্থা—সবই এখন এই ট্রানজিস্টর, আইসি ও মাইক্রোপ্রসেসরের দখলে। এগুলোর প্রাণভোমরা কোনো না কোনো মাইক্রোপ্রসেসর, আইসি বা ইন্টিগ্রেটেড বোর্ড। বলা হয়ে থাকে এখন পৃথিবীতে একজন মানুষের বিপরীতে প্রায় ৫০টি চিপস সক্রিয়!

বলা বাহুল্য, এই বিশাল যন্ত্রপাতি তৈরি করেছে এক বিরাট বাজার। কারণ, কাউকে না কাউকে এই সেমিকন্ডাক্টর ডিভাইসগুলো চিন্তা করতে হয়, কাগজে আঁকতে হয়, কম্পিউটারে ডিজাইন করতে হয়, তারপর কোথাও না কোথাও সেগুলো বানানোর পাশাপাশি প্যাকেজিং করতে হয়। গত বছর সেমিকন্ডাক্টরের বৈশ্বিক বাজার ছিল প্রায় ৫২ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের। ২০২৮ সাল নাগাদ এই বাজারের আকার দাঁড়াবে ৮০ হাজার কোটি ডলারে। এই ক্রমবর্ধমান চাহিদার মূল কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), মেশিন লার্নিং, রোবোটিক প্রসেস অটোমেশন (আরপিএ), ক্লাউড কম্পিউটিং, পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল সেবা ইত্যাদি। বিশ্বব্যাপী একদল বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী সার্বক্ষণিকভাবে চেষ্টা করে চলেছেন মানুষের জীবনযাত্রাকে আরও সহজ ও স্বয়ংক্রিয় করতে। আর সে জন্য জন্ম নিচ্ছে সেমিকন্ডাক্টরভিত্তিক নানা রকম প্রযুক্তি ও প্রকৌশলের।

বাংলাদেশে এই শিল্প

সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রির বিকাশ বিভিন্ন দেশকে নতুন করে এই শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট করে তুলছে। গত বছর পার্শ্ববর্তী দেশের সরকার এই শিল্প গড়ে তোলার জন্য ১ হাজার কোটি ডলারের প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। এর মাধ্যমে ভারতে সেমিকন্ডাক্টর ও ডিসপ্লে খাতে প্রয়োজনীয় সরকারি সহযোগিতা দেওয়া হবে। এই বিশেষ প্যাকেজের আওতায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ভারতে সেমিকন্ডাক্টর ফ্যাব্রিকেশন ল্যাব, ডিসপ্লে ফ্যাব্রিকেশন ল্যাব, কম্পাউন্ড সেমিকন্ডাক্টর ফটোনিকস, সেন্সর, সেমিকন্ডাক্টর প্যাকেজিং ইত্যাদি খাতে এই প্রণোদনা দেওয়া হবে।

দেড় দশকেরও আগে দেশে সেমিকন্ডাক্টর কার্যক্রমের সূচনা করেন প্রকৌশলী দিদার ইসলাম। তিনি গড়ে তোলেন পাওয়ার আইসি নামে একটি প্রতিষ্ঠান। উদ্দেশ্য ছিল, চিপের ফ্রন্ট অ্যান্ড ডিজাইনের কাজ থেকে ক্রমাগত একটি ফ্যাব্রিকেশন বা চিপ বানানোর ফ্যাসিলিটি গড়ে তোলা। কিন্তু নানা বাধায় এই কাজে সফল হতে পারেননি। পরে গড়ে তোলেন সোলারিক নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে দেশে সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে নানা কাজ করছে। সোলারিক ছাড়াও বর্তমানে দেশে উল্কাসেমি, প্রাইম সিলিকন, নিউরাল সেমিকন্ডাক্টর, টেটোন ইলেকট্রনিকস নামে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এই খাতে কাজ করছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী মনে করেন, সরকারের বিশেষ নজর ছাড়া প্রযুক্তিনির্ভর এই শিল্প পরিপূর্ণভাবে কখনোই গড়ে তোলা সম্ভব নয়। কারণ, এই শিল্পের জন্য প্রচুর বিনিয়োগ দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে এমন দামি ক্লিনরুম এনভায়রনমেন্ট সংরক্ষণ, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রচুর খরচসাপেক্ষ। যদিও বাংলাদেশ পরমানু শক্তি কমিশনের আংশিক সক্ষমতার সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু তাদের গবেষণা করার মতো শিক্ষার্থী নেই। তিনি জানান, বুয়েটে এ বিষয়ে যথেষ্ট তাত্ত্বিক ভিত্তিমূলক কোর্স ও ভিএলএসআইবিষয়ক কোর্স পড়ানো হয়। ল্যাবও করানো হয়। তবে এই শিল্পের জন্য ছেলেমেয়েদের তৈরি করতে দরকার হাতে–কলমে প্রশিক্ষণ এবং যাঁরা এই শিল্পে কাজ করেছেন তাঁদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান। অধ্যাপক ফারসীম জানান, দেশের অনেক প্রকৌশলীই ইন্টেল, টিএসএমসিসহ নানা জায়গায় কাজ করেছেন বা করছেন। তাঁদের সঙ্গে দেশের শিল্পের একটি যোগাযোগ দরকার।

শুধু ইন্টেলেই বাংলাদেশের প্রায় ৪০০ প্রকৌশলী কর্মরত রয়েছেন। তাঁদের সহায়তাই ২০০০ সালে ইন্টেলের সহপ্রতিষ্ঠাতার নামে বুয়েটে ‘রবার্ট নয়েস সিমুলেশন ল্যাব’ চালু করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাইনুল হোসেন অবশ্য মনে করেন, তাত্ত্বিক ভিত্তির পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চিপশিল্পের ব্যবহারিক বিষয়েও হাতে–কলমে শিক্ষার প্রয়োজন। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগার এবং সীমিত আকারের ক্লিন রুম যেমন বানাতে হবে, তেমনি এই খাতে গবেষণার ব্যাপারটিকেও প্রাধান্য দিতে হবে। ইন্ডাস্ট্রি স্কেলে একটি পুরোদস্তুর সেমিকন্ডাক্টর চিপ ফ্যাব্রিকেশন ফ্যাসিলিটি তৈরিতে বিরাট অঙ্কের বিনিয়োগের আগে তুলনামূলকভাবে কম বিনিয়োগে করা সম্ভব, এমন কিছু সেক্টর (যেমন চিপ প্যাকেজিং) দিয়ে কাজ শুরু করা যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরির এই সম্ভাবনাময় খাতের বিকাশে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার জন্য মাইনুল হোসেন সরকার ও প্রবাসীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। গ্লোবালফাউন্ড্রিজ (ও আইবিএমের) এই সাবেক মুখ্য প্রকৌশলী আরও বলেন, বাংলাদেশের প্রবাসীদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ এই খাতে কাজ করছেন। তাঁদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে।

প্রকৌশলীদের এই খাতের জন্য তৈরি করতে দেশে এখন পর্যন্ত একমাত্র প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট তাহো। এই প্রতিষ্ঠানে চিপ ডিজাইন প্রযুক্তির বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রকৌশলী আলিয়া শাফকাত জানান, ২০১৯ সালে কার্যক্রম শুরু করে তাঁরা এখন পর্যন্ত প্রায় ১৭০ জনকে প্রশিক্ষিত করেছেন। এর মধ্যে অনেকেই দেশে ও বিদেশে চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু করোনার সময় সব কর্মকাণ্ড অনলাইনে স্থানান্তরিত হয়। এখন আবার প্রশিক্ষণ শুরু করবেন বলে জানান তিনি।

নিউরাল সেমিকন্ডাক্টর

সেমিকন্ডাক্টর খাতে দেশীয় যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম নিউরাল সেমিকন্ডাক্টর লিমিটেড। ২০১৭ সালের এপ্রিলে বুয়েটের ২০ জন তড়িৎ প্রকৌশলীকে নিয়ে নিউরাল সেমিকন্ডাক্টরের যাত্রা শুরু। এটি রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ডিবিএল গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান।

প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা প্রকৌশলী মো. সাখাওয়াত হোসেন জানান, নিউরাল বর্তমানে প্রি-ফ্যাব পর্যায়ে অ্যানালগ ডিজাইন, ডিজিটাল ডিজাইন, ডিজিটাল ভেরিফিকেশন, ফিজিক্যাল ও টেস্টিংয়ের ডিজাইন পর্যায়ে কাজ করে। পাঁচ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও মালয়েশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করছে।

সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ২০১৭-২০১৮ সালের দিকে প্রকৌশলীদের এই খাতে আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জ ছিল, সেটি অনেকাংশে কমে এসেছে। ইতিমধ্যে তাঁদের প্রতিষ্ঠানেই প্রকৌশলীর সংখ্যা ১০০ পেরিয়েছে। চলতি বছরে এটি দ্বিগুণ হবে। তবে তাত্ত্বিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ প্রকৌশলীদের উৎপাদনের কাজে নিযুক্ত করার আগে তাঁদের হাতে–কলমে নিবিড় প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। এ জন্য উচ্চমূল্যের বাণিজ্যিক সফটওয়্যার, ইলেকট্রনিক ডিজাইন অটোমেশন টুলস ও কখনো বিদেশি বিশেষজ্ঞের দরকার।

১৯৯১ সালে ঢাকার গ্রিন রোডে ছোট কারখানা দিয়ে যাত্রা শুরু ডিবিএল গ্রুপের। পোশাক দিয়ে শুরু হলেও গত ৩০ বছরের ব্যবসায় সিরামিক টাইলস, তথ্যপ্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগ, ড্রেজিংসহ বিভিন্ন ব্যবসায় নাম লিখিয়েছে তারা।

ডিবিএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ জব্বার বলেন, সেমিকন্ডাক্টর খাত বিকাশের জন্য সরকারের বিশেষ উদ্যোগ দরকার। পার্শ্ববর্তী দেশের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠ্যক্রমের আধুনিকায়নসহ শিল্পমানের পরীক্ষাগার গড়ে তোলা দরকার। সেখানে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ থাকবে। তাতে যেটি হবে, প্রকৌশলীরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রয়োজনীয় শিল্প-দক্ষতা নিয়েই বের হবেন। তখন তাঁরা সরাসরি শিল্পে কাজ করতে পারবেন।

এম এ জব্বার বলেন, ‘বিশ্বে সেমিকন্ডাক্টর খাতের প্রয়োজনীয়তা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আমাদেরও একটি রূপকল্পের মাধ্যমে দ্রুত অনেক কাজ করা দরকার। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পোস্ট–ফ্যাব পর্যায়ে প্যাকেজিং ও টেস্টিংয়ের কাজ আমরা শুরু করতে পারব। এ জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা, যেমন ক্লিনরুম ফ্যাসিলিটি, কোয়ালিটি পাওয়ার সাপ্লাইয়ের জন্য সরকারের সহযোগিতা দরকার।’

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী চিপের পাশাপাশি দক্ষ প্রকৌশলীর সংকট দেখা দিয়েছে উল্লেখ করে এম এ জব্বার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেক দেশ নিজেদের শিল্পের দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি দক্ষ প্রকৌশলী তৈরির কাজে বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে। বাংলাদেশও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে একটি সেল গঠন করে বেসরকারি খাতে প্রয়োজনীয় সহায়তা করতে পারে।

দেড় দশকে উল্কাসেমি

প্রকৌশলী এনায়েতুর রহমান বুয়েট থেকে ১৯৭৭ সালে স্নাতক ও পরে যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে তড়িৎ ও কম্পিউটারবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষ করে বিশ্বখ্যাত চিপ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এএমডিতে দীর্ঘদিন কাজ করেন। নিজেই নকশা করার পাশাপাশি তৈরি করেছেন বেশ কিছু সেমিকন্ডাক্টর চিপ। এএমডি ছাড়ার পর তিনি দেশে কিছু করার কথা ভাবছিলেন। ২০০৭ সালে মাত্র চারজন প্রকৌশলী নিয়ে ঢাকায় সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে কাজ করার জন্য উল্কাসেমি নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। সেটির সদর দপ্তর সিলিকন ভ্যালিতে।

সম্প্রতি এই প্রতিবেদককে এনায়েতুর রহমান জানান, শুরুতে বাংলাদেশে চিপ নিয়ে কাজ হতে পারে, এটি বোঝাতেই অনেক কষ্ট হয়েছে। ২০০৮ সাল থেকে মূলত তাঁরা সার্কিট ডিজাইন ও লে-আউটের কাজ পেতে শুরু করেন। ২০১২ সাল থেকে চিপ ডিজাইন ও ভেরিফিকেশনের কাজে যুক্ত হয় উল্কাসেমি। কাজ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কানাডার টরন্টো ও ভারতের বেঙ্গালুরুতেও আরও দুটি অফিস খুলতে হয়। ধীরে ধীরে কাজের পরিমাণ বাড়তে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে প্রকৌশলীর সংখ্যাও। বর্তমানে উল্কাসেমিতে ৩০০ কর্মী কাজ করছেন। ২০২৪ সালের মধ্যে কর্মীর সংখ্যা ৫০০-তে উন্নীত করার পরিকল্পনার কথা জানান এনায়েতুর রহমান।

২০২১ সালে উল্কাসেমি বিশ্বের অন্যতম প্রধান সেমিকন্ডাক্টর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি, টিএমএসসির ডিজাইন সেন্টার অ্যালায়েন্স পার্টনার হয়েছে। বিশ্বের মাত্র ২০টি প্রতিষ্ঠান টিএমএসসির ডিজাইন সেন্টার অ্যালায়েন্সের সঙ্গে যুক্ত। ক্রমবর্ধমান এই শিল্পের প্রতি বিশেষভাবে নজর দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন এনায়েতুর রহমান। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা জোরদার করা দরকার। বুয়েটের অধ্যাপক ফারসীম মান্নানের মতো তিনিও মনে করেন, এ ব্যাপারে একাডেমিয়া ও শিল্পের সম্পর্ক জোরদার ও প্রবাসী বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগানো দরকার। পাশাপাশি সেমিকন্ডাক্টর খাতের সম্ভাবনার ব্যাপারে নীতিনির্ধারদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য গণমাধ্যমেরও বিশেষ ভূমিকা নেওয়া দরকার।

ভারতের ১ হাজার কোটি ডলারের প্রণোদনার কথা উল্লেখ করে এনায়েতুর রহমান বাংলাদেশ সরকারকেও অনুরূপ উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানান।