সম্ভাবনাময় নেপালের বাজার, আগ্রহ কম বাংলাদেশের!
কাঠমান্ডুর প্রদর্শনী মার্গ এলাকায় নেপাল ট্যুরিজম বোর্ডের কার্যালয়। পাশের সড়কে ছোট ছোট টংদোকানে প্রাণ গ্রুপের চিপসের প্যাকেট ঝুলছে। পরিচিত মোড়ক দেখে এগিয়ে যেতেই বাংলাদেশি এই ব্র্যান্ডের চানাচুর, লিচি ড্রিংক, ম্যাঙ্গো বার, বিস্কুট, চকলেট ইত্যাদি পণ্যের দেখা মিলল। প্রাণের পাশাপাশি ভারতীয় অনেক ব্র্যান্ডের পণ্যও আছে দোকানটিতে।
২০০৯ সালে হিমালয়কন্যা খ্যাত নেপালে খাদ্যপণ্য রপ্তানি শুরু করে বাংলাদেশের স্বনামধন্য ব্র্যান্ড প্রাণ। ইতিমধ্যে নেপালে প্রাণের পরিবেশক একটি কারখানাও স্থাপন করেছে। আপাতত সেখানে চিপস তৈরি হচ্ছে। ভবিষ্যতে অন্যান্য পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করা হবে। এমন তথ্য দিয়ে নেপালে প্রাণের কান্ট্রি ম্যানেজার হারুন আল রশীদ জানালেন, নেপালিরা বাংলাদেশি পণ্য খুবই পছন্দ করে। ভালো চাহিদা থাকায় প্রতিবছর প্রাণের পণ্য বিক্রি বাড়ছে।
ঢাকায় প্রাণ গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রাণ বাংলাদেশ থেকে নেপালে ৭০ লাখ ডলারের খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে। পরের অর্থবছরে রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়ে ৯৫ লাখ ডলার হয়। চলতি অর্থবছরের (২০১৬-১৭) প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) প্রাণের রপ্তানি ১ কোটি ৩৫ লাখ ডলার হয়েছে। এর বাইরে নেপালে স্থাপিত কারখানা থেকে বছরে কয়েক কোটি নেপালি রুপির চিপস স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয়।
জানা গেল, প্রাণের দেখানো পথ ধরে ওয়ালটন ইলেকট্রনিকস, সজীব ফুড ও গ্লোব খাদ্যপণ্য, অ্যাডভান্সড ডেভেলপমেন্ট টেকনোলজি নির্মাণসামগ্রী ও শরিফ মেটাল স্যানিটারি পণ্য রপ্তানি করছে নেপালে। সর্বশেষ গত ৩০ এপ্রিল কাঠমান্ডুর বাণিজ্যিক এলাকা ত্রিপুরেশ্বরে ইউনাইটেড ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে চালু হয়েছে হাতিলের ফ্র্যাঞ্চাইজি বিক্রয়কেন্দ্র। উদ্বোধনের দিনেই প্রায় ১০ লাখ নেপালি রুপির আসবাবের বিক্রয়াদেশ পেয়েছে হাতিল।
তিন বছর আগেও বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে নেপালই এগিয়ে ছিল। এখন পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে। নেপালের বাণিজ্য ও সরবরাহ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেল, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ১ কোটি ৯৫ লাখ ডলারের পণ্য আমদানির বিপরীতে রপ্তানি করে ১ কোটি ৮৯ লাখ ডলারের পণ্য। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ২ কোটি ৪৩ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করার বিপরীতে আমদানি করেছিল ১ কোটি ৯০ লাখ ডলারের পণ্য। গত বছর বাংলাদেশ ৪ কোটি ৬৬ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করে আর আমদানি করে ১ কোটি ২৯ লাখ ডলারের পণ্য।
এইটুকু ইতিবাচক খবরের আবার উল্টো পিঠ আছে। নেপালের সামগ্রিক আমদানির বিপরীতে বাংলাদেশের অবস্থান খুবই নগণ্য। বিভিন্ন দেশ থেকে গত বছর নেপাল ৮৮৯ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে। তার মধ্যে কেবল ভারত থেকেই এসেছে ৬৫ শতাংশ বা ৫৮৫ কোটি ডলারের পণ্য। দ্বিতীয় চীন থেকে এসেছে ১৪ শতাংশ বা ১২৪ কোটি ডলারের পণ্য। সেখানে বাংলাদেশের অবদান মাত্র দশমিক ৫ শতাংশ।
হাতিলের বিক্রয়কেন্দ্র উদ্বোধনের রাতে কাঠমান্ডুতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস তাঁর বাসভবনে নিজ দেশের ব্যবসায়ীদের নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি বলেন, নেপাল তাদের প্রয়োজনীয় পণ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করে, যার বেশির ভাগ পণ্যই ভারত থেকে আসে। আমাদের পণ্য এখানে খুব কম। কারণ নেপালের মানুষের যে ক্রয়ক্ষমতা, তা নিয়ে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সচেতন নন।
নেপাল বাংলাদেশ থেকে আয়তনে খানিকটা ছোট। দেশটির ২ কোটি ৮০ লাখ মানুষের মধ্যে ৭৫ লাখই বিদেশে থাকেন। ফলে নেপালে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসে। পর্যটনের পরই প্রবাসী আয় দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস। এমন তথ্য দিয়ে মাশফি বিনতে শামস বললেন, ‘নেপালের জনগণের ক্রয়ক্ষমতা খুবই ভালো। আমাদের সিরামিক, মেলামাইন, হোম টেক্সটাইল, টেরিটাওয়েল ও পোশাক ব্যবসায়ীরা আগ্রহী হলে এ দেশে ভালো ব্যবসার সম্ভাবনা রয়েছে।’
ছোট দেশ বলে নেপালকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। সম্ভাবনাময় এই বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের প্রসার ঘটানোর বেশ সুযোগ রয়েছে। সে জন্য সরকার ও ব্যবসায়ীদের নেপালে গিয়ে বাজার পর্যবেক্ষণ করা দরকার বলে মনে করেন হাতিলের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম এইচ রহমান। তিনি বলেন, নেপালে শিগগিরই আরও বিক্রয়কেন্দ্র খোলার ইচ্ছা আছে হাতিলের স্থানীয় অংশীদার আখিল ট্রেডিং কনসার্নের।
নেপাল সফরকালে দেশটির রাজধানী কাঠমান্ডুর প্রধান পর্যটন এলাকা থামেলের পাশেই দরবার মার্গের মূল সড়কের দুপাশেই দেখা গেল অ্যাডিডাস, নাইকি, পুমা, জারা, লিভাইস, নর্থ ফেইস, ইউএস পলোর মতো বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের চোখধাঁধানো বিক্রয়কেন্দ্র। সেখানে বাংলাদেশের আড়ং, ইউলো কিংবা অ্যাপেক্সের মতো ব্র্যান্ড থাকতেই পারে। এতে ব্যবসার পাশাপাশি ব্র্যান্ডিংটাও ভালো হবে। কারণ সারা বছরই পুরো দুনিয়ার লাখ লাখ পর্যটক নেপালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে ভিড় করেন।
নেপালের তিন পাশেই ভারতের সীমান্ত। নেপালের নিজস্ব কোনো সমুদ্রবন্দর নেই। সে জন্য রপ্তানিতে শুল্ক ছাড়াও বেশ কিছু অশুল্ক বাধা আছে। সেসব নিয়ে সরকারের কাজ করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন ব্যবস্থাপক কামরুজ্জামান কামাল। তবে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এই সম্ভাবনাময় বাজারটি নিয়ে তেমন একটা আগ্রহ নেই। মাথাব্যথা নেই। এমনটাই অভিযোগ করলেন কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।