সম্ভাবনা থাকলেও রপ্তানি তলানিতে

দেশে গত তিন দশকে ৮ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা বিনিয়োগে ৩২টি টাইলস কারখানা গড়ে উঠেছে। মানসম্মত টাইলস উৎপাদনের জন্য দেশীয় কারখানাগুলোর সুনাম আছে। হাতে গোনা কয়েকটি কারখানা বিদেশে টাইলস রপ্তানি করলেও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় ভালো করতে পারেনি। যে কারণে টাইলস রপ্তানি এখনো ১০ লাখ ডলারের নিচে।

গাজীপুরে ডিবিএল িসরামিকসের কারখানা ভবন
ছবি: সংগৃহীত

একসময় কুমারের হাতে তৈরি মাটির থালাবাটিই ছিল এ অঞ্চলের মানুষের ভরসা। সেই ভরসা অনেক আগেই অতীত হয়ে গেছে। গত শতকের ষাটের দশকে এই ভূখণ্ডে মাটির পরিবর্তে সিরামিকের থালাবাটির প্রচলন শুরু হয়। বর্তমানে শহর–গ্রাম–গঞ্জনির্বিশেষে সর্বত্রই একচ্ছত্রভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে দেশীয় কারখানায় উৎপাদিত সিরামিকের থালাবাটিসহ বিভিন্ন ধরনের জিনিস। শুধু তা–ই নয়, মানুষজন এখন দেশীয় সিরামিক টাইলস দিয়ে নিজেদের অফিস ভবন ও বাড়ির মেঝে, দেয়াল ও শৌচাগারকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলছে।

দেশ থেকে সিরামিক পণ্যের রপ্তানিও শুরু হয়েছিল প্রায় চার দশক আগে। মুন্নু সিরামিকের হাত ধরে ১৯৮৫ সালে প্রথম সিরামিকের টেবিলওয়্যার বা বাসনকোসন রপ্তানি শুরু হয়। সময়ের ব্যবধানে আরও কিছু প্রতিষ্ঠান রপ্তানিতে নাম লেখায়। তাতে বাসনকোসনের রপ্তানি একটা পর্যায়ে গেলেও সিরামিকশিল্পের অন্য দুই উপখাত—টাইলস ও স্যানিটারিওয়্যার রপ্তানিতে কোনো সুসংবাদ নেই। যদিও এসব পণ্য উৎপাদনের কারখানার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। সিরামিক বাসনকোসনের কারখানা যেখানে ২০টি, সেখানে টাইলসের ৩২টি ও স্যানিটারিওয়্যারের কারখানা রয়েছে ১৮টি।

বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি হলো পোশাক। আশির দশকে পোশাকের রপ্তানি হাঁটি হাঁটি পায়ে শুরু হয়। সেই পোশাকের বার্ষিক রপ্তানি বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১৪৫ কোটি ডলার। অন্যদিকে আশির দশকের মাঝামাঝি রপ্তানি শুরু হওয়া সিরামিক পণ্যের রপ্তানি এখনো ৫-৬ কোটি ডলারেই আটকে আছে। এর মধ্যে টাইলসের রপ্তানি ১০ লাখ ডলারের নিচে।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশে গত তিন দশকে ৮ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা বিনিয়োগে ৩২টি সিরামিক টাইলস কারখানা গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে আছে ৩০টি। বাকি দুটি কারখানা শিগগিরই উৎপাদন শুরু করবে। টাইলস কারখানাগুলো মানসম্মত টাইলস উৎপাদন করলেও শুরুতে তাদের নজর ছিল দেশীয় বাজারে। কারণ, দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এবং সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বৃদ্ধি পাওয়াসহ নানা কারণে দেশীয় টাইলসের বাজার বছর বছর বাড়ছে। দেশীয় বাজারের ব্যবসার সম্ভাবনা কাজে লাগানোর পাশাপাশি রপ্তানিও শুরু করে হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানি। তবে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে সেটি বেশি দূর এগোয়নি।

ব্যবসায়ীরা জানান, শুধুমাত্র সিরামিক টাইলসের বৈশ্বিক বাজার ৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের। এই বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে চীন, ভারত, স্পেন, ইতালি, ইরান, তুরস্ক, ব্রাজিল, পোল্যান্ড, মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। আগামী ২০২৮ সালে টাইলসের বৈশ্বিক বাজার ৭ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। অর্থাৎ টাইলসের রপ্তানি সম্ভাবনা আগামী দিনে যে আরও বাড়বে, তা নিঃসন্দেহ।

গাজীপুরে গ্রেট ওয়াল সিরামিকের কারখানায় টাইলস উৎপাদনের কাজ চলছে
ছবি: সংগৃহীত

দেশে সিরামিক পণ্যের রপ্তানি পরিসংখ্যান নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি আছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৩ কোটি ১১ লাখ ডলারের সিরামিক পণ্য। অন্যদিকে বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমইএ) দাবি করেছে, ওই অর্থবছরে ৪ কোটি ১৭ লাখ ডলারের সিরামিক পণ্য রপ্তানি হয়েছে। তার মধ্যে টাইলস রপ্তানি হয়েছে ৯ লাখ ৫০ হাজার ডলারের।

হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে দেড় লাখ বর্গমিটার আয়তনের কারখানায় ২০১৩ সালে বাণিজ্যিকভাবে টাইলস উৎপাদন শুরু করে বাংলাদেশ ও লেবাননের যৌথ বিনিয়োগের কোম্পানি স্টার সিরামিকস। বর্তমানে তাদের দৈনিক উৎপাদনক্ষমতা ২ লাখ ১৫ হাজার বর্গমিটার। প্রতিষ্ঠানটি একসময় ভারত ও ভুটানে টাইলস রপ্তানি করলেও দুই অর্থবছর ধরে সেটি বন্ধ রয়েছে।

জানতে চাইলে স্টার সিরামিকসের মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয়) সৈয়দ আলী আবদুল্লাহ জামি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সড়কপথে পণ্য পাঠাতে নানা ঝামেলা। তা ছাড়া প্রতিযোগীদের তুলনায় আমাদের পণ্যের দাম বেশি। তাই রপ্তানি আপাতত বন্ধ।’ তিনি বলেন, ‘টাইলসের কাঁচামালের শতভাগই আমদানি করতে হয়। সেই কাঁচামালের ওপর আবার শুল্ক-কর আরোপ করা আছে। তাতে আমাদের পণ্যের উৎপাদন খরচ তুলনামূলক বেশি পড়ে। সে জন্য আমরা চীন ও ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছি না।’

সৈয়দ আলী আবদুল্লাহ জামি আরও বলেন, ‘টাইলস রপ্তানিতে বাংলাদেশের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক-কর কমানো গেলেই সেটি সম্ভব। যেহেতু আমাদের দেশের কোম্পানিগুলো উন্নত মানের টাইলস উৎপাদন করছে ফলে মান নিয়ে সমস্যা হবে না।’ তিনি জানান, বর্তমানে কাঁচামালভেদে ৫-২৫ শতাংশ শুল্ক-কর আরোপ করা আছে।

জানতে চাইলে বিসিএমইএ সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, ‘টাইলস একসময় বিলাসপণ্য ছিল।তবে বর্তমানে সেটি নিত্যপণ্য।স্বাস্থ্যসম্মত পণ্যও বটে।ফলে সিরামিকের কাঁচামাল আমদানিতে কোনো ধরনের শুল্ক-কর থাকা উচিত নয়।কিন্তু খাতটি নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর সব সময়ই বিমাতাসুলভ আচরণ করছে।জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমরা বহুবার কথা বলেছি।কাঁচামাল আমদানিতে আরোপিত শুল্ক-কর তুলে নেওয়া হলে এই খাতের রপ্তানি সম্ভাবনা উন্মোচিত হবে।’