সর্বোচ্চ করদাতা হতে কাউছ মিয়া যা করেন

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালসহ অন্যদের কাছ থেকে সেরা করদাতার সম্মাননা নিচ্ছেন কাউছ মিয়া। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর র‌্যাডিসন হোটেলে। ছবি: প্রথম আলো
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালসহ অন্যদের কাছ থেকে সেরা করদাতার সম্মাননা নিচ্ছেন কাউছ মিয়া। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর র‌্যাডিসন হোটেলে। ছবি: প্রথম আলো

কাউছ মিয়া সব সময়ই সর্বোচ্চ করদাতা থাকতে চান। অন্য কেউ যাতে তাঁর জায়গা দখল করতে না পারেন, সে জন্য তিনি আগেভাগেই ৫ কোটি টাকার চেক জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) দিয়ে রাখেন। ৮৯ বছর বয়সী কাউছ মিয়া হাকিমপুরী জর্দার মালিক হিসেবে সারা দেশে পরিচিত। হাকিমপুরী জর্দার কৌটায় তাঁর ছবি থাকে।

২০০৮ সাল থেকে তিনি ব্যবসায়ী শ্রেণিতে সর্বোচ্চ করদাতার একজন। অবশ্য অন্য শ্রেণির সর্বোচ্চ করদাতারা প্রতিবছর কর হিসেবে যত টাকা কর দেন, তাঁরা কাউছ মিয়ার ধারে–কাছে নেই।

গত বৃহস্পতিবার এনবিআরের পক্ষ থেকে এ বছরের সেরা করদাতাদের হাতে কর কার্ড ও সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেওয়া হয়। ওই অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া প্রতিবছর কাউছ মিয়ার সর্বোচ্চ করদাতা হওয়ার প্রতিজ্ঞার পেছনের গল্পটি উপস্থিত অতিথিদের জানিয়ে দেন। অনুষ্ঠানে কাউছ মিয়া নিজেই উপস্থিত ছিলেন।

এনবিআর চেয়ারম্যান গল্পটি বলেন এভাবে, কাউছ মিয়া প্রতিবছর তাঁর আয়কর বিবরণী জমা দেন। পুরস্কার প্রদানের সময় এলে সংশ্লিষ্ট মাঠপর্যায়ের কর কর্মকর্তারা কাউছ মিয়াকে বলেন, এবার মনে হয় আপনি সর্বোচ্চ করদাতা হতে পারবেন না। তখন কাউছ মিয়া বলেন, কত টাকা দিলে সর্বোচ্চ করদাতা হতে পারব? এর দু-এক দিন পরেই তিনি ৫ কোটি টাকার চেক পাঠিয়ে দেন।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, কাউছ মিয়া প্রতিবছর ৪৩ থেকে ৪৫ কোটি টাকা কর দেন।

কাউছ মিয়া ৬১ বছর ধরে কর দিয়ে আসছেন। ১৯৫৮ সালে প্রথম কর দেন তিনি। কেন কর দেওয়া শুরু করলেন, এর ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার এনবিআরের ওই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আগে টাকাপয়সা এখানে–সেখানে রাখতাম। এতে নানা ঝামেলা ও ঝুঁকি থাকত। ১৯৫৮ সালে প্রথম কর দিয়ে ‘ফ্রি’ হয়ে গেলাম। এরপর সব টাকাপয়সা ব্যাংকে রাখতে শুরু করলাম। হিসাবনিকাশ পরিষ্কার করে রাখলাম। ১৯৬৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এক নম্বর করদাতা হয়েছিলেন কাউছ মিয়া।

কাউছ মিয়ার বাবা চাইতেন না তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যে নামেন। তাঁর বাবা চাইতেন তিনি যেন পড়াশোনা চালিয়ে যান। ব্যবসায় মন পড়ে থাকা কাউছ মিয়া ১৯৪৫ সালে অষ্টম শ্রেণি পাস করে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দামামায় আর পড়াশোনা এগোয়নি।

বাবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ১৯৫০ সালে চাঁদপুরের পুরান বাজারে মুদিদোকান দেন। এরপর ধীরে ধীরে ১৮টি ব্র্যান্ডের সিগারেট, বিস্কুট ও সাবানের এজেন্ট ছিলেন। পরের ২০ বছর তিনি চাঁদপুরেই ব্যবসা করেন। ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন এবং তামাকের ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে ৪০-৪৫ ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তিনি। তবে তাঁর মূল ব্যবসা তামাক বেচাকেনা। রংপুরে তামাক কিনে সেখানেই বিক্রি করেন। একবার তিনি আমদানির ব্যবসায় নামতে লাইসেন্স নিয়েছিলেন। এ ব্যবসায় কারসাজি না করলে টিকে থাকা মুশকিল—এটা চিন্তা করে আমদানির ব্যবসা ছাড়েন। বর্তমানে নদীপথে পণ্য পরিবহনের জন্য ১৮টি কার্গো জাহাজ আছে কাউছ মিয়ার। এই ব্যবসা তাঁর ছেলেরা দেখাশোনা করেন।

গুলশান-বনানী কিংবা মতিঝিলের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত চেম্বার নেই কাউছ মিয়ার। পুরান ঢাকার আগা নওয়াব দেউড়ি রোডের হাকিমপুরী জর্দার কারখানার    একটি কক্ষই তাঁর ‘চেম্বার’। মৌলভীবাজার থেকে সরু এই গলিপথ ধরে কিছুটা পথ হাঁটলেই তাঁর কারখানা। সেখানেই বসেন তিনি। গুলশান-বনানী, মতিঝিলের ডাকসাইটের ব্যবসায়ীদের পেছনে ফেলে পুরান ঢাকার ঘুপচি গলির এই ব্যবসায়ীই প্রতিবছর সর্বোচ্চ করদাতা হন।