বাংলাদেশে এখন সাড়ে ১১ হাজার মানুষ আছেন, যাঁদের সোয়া দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে। তাঁরা বছর শেষে আয়কর দিয়ে সারচার্জ দিয়েছেন। বাংলাদেশে যত লোক আয়কর বিবরণী জমা দেন, তার ১ শতাংশের কম লোক সোয়া দুই কোটি টাকার সম্পদের মালিক। কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) আছে, এমন ব্যক্তিদের মাত্র দশমিক ৩০ শতাংশের মতো সারচার্জ দেন। এমনিতেই বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় করদাতার সংখ্যা অত্যন্ত কম।
কিন্তু বাস্তবে সম্পদধারী মানুষের সংখ্যা কম নয়। রাজধানীর ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, উত্তরার মতো অভিজাত এলাকায় অনেক লোক বিলাসবহুল ও জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাপন করেন। এসব অভিজাত এলাকায় কোটি টাকার নিচে ফ্ল্যাট মিলবে না। বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ, পোরশে, লেক্সাসের মতো দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি হাঁকান অনেকে। বিএমডব্লিউ গাড়ি বিক্রিতে এশিয়ায় পঞ্চম বাংলাদেশ। আবার কর ফাঁকি দেওয়া গাড়ি ধরতে অভিযান শুরু হওয়ার পর রাজধানীর রাস্তায় বিলাসবহুল গাড়ি ফেলে চলে যান করদাতা, সম্প্রতি এমন ঘটনাও ঘটেছে। অনেকেই বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ির মতো সম্পদ আয়কর বিবরণীতে দেখান না। কিংবা আইনের ফাঁকফোকরের কারণেই তাঁদের এই সম্পদ দেখাতে হয় না।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বার্ষিক রিটার্ন জমা দিয়ে ১১ হাজার ৬৭০ জন করদাতা সারচার্জ দিয়েছেন। তাঁদের সোয়া দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদ আছে বলে রিটার্নে দেখিয়েছেন। এ জন্য তাঁদের কাছ থেকে ৩৬০ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে এনবিআর। করদাতার যে কর দেন সম্পদের মূল্য ভেদে ওই করের ওপর ১০ থেকে ৩০ শতাংশ সারচার্জ বসে।
২০১১-১২ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো সারচার্জ দেওয়ার বিধান করা হয়। তখন দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদ থাকলে সারচার্জ দিতে হতো। গত ছয় বছরে এমন সম্পদধারী আড়াই গুণ বেড়েছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে মাত্র ৪ হাজার ৪৪৬ জন করদাতা রিটার্ন জমা দিয়ে মাত্র ৪৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা সারচার্জ দিয়েছেন।
অবশ্য সারচার্জ আরোপের ক্ষেত্রে সম্পদের মূল্য নির্ধারণে জটিলতা আছে। বাড়ি, গাড়ির মতো স্থাবর সম্পদ ওই করদাতা যে দামে কিনেছেন, সেই দামকে ধরেই সম্পদের মূল্য ধরা হয়। এতে অনেক সম্পদশালী সারচার্জের আওতার বাইরে থেকে যান।
এটি একটি বৈষম্যমূলক সম্পদ নির্ধারণ পদ্ধতি বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যে সময় ফ্ল্যাট কিংবা প্লট কেনা হয়, সেই কেনা মূল্যই সারা জীবন করদাতাকে রিটার্নে দেখাতে হয়। এর ফলে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও অনেকে সারচার্জের আওতার বাইরে থাকছেন, যা বৈষম্যমূলক। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, কোনো করদাতা যদি সত্তরের দশকে গুলশানে এক লাখ টাকা দিয়ে ১০ কাঠার একটি প্লট কেনেন। এখন পর্যন্ত ওই করদাতা ওই প্লটের দাম রিটার্নে ১ লাখ টাকাই দেখান। বাস্তবে এর মূল্য হয়তো ৩০-৪০ কোটি টাকা হয়ে গেছে। অথচ গত বছর যিনি গুলশানে ফ্ল্যাট কিনেছেন, তাঁকেও সারচার্জ দিতে হয়েছে। কেননা, গুলশানে সোয়া দুই কোটি টাকার কমে ফ্ল্যাট পাওয়া মুশকিল।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে (২০১৫-১৬) ১০ হাজার ৯২৭ জন করদাতা ২৮৮ কোটি টাকা সারচার্জ দিয়েছেন। এর আগের অর্থবছরে ১০ হাজার ৯৩১ জন করদাতার কাছ থেকে এনবিআর সারচার্জ পেয়েছে ২৫৪ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সারচার্জ আদায়ের পরিমাণ ছিল ২৫৪ কোটি টাকা। ওই বছর ১০ হাজার ১৫২ জন করদাতা সারচার্জ দিয়েছেন। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫ হাজার ৬৬২ জন করদাতা ৬০ কোটি টাকা সারচার্জ দিয়েছেন।
অথচ শুধু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রায় সাড়ে তিন লাখ বাড়ি বা হোল্ডিং রয়েছে। যেসব বাড়ির প্রতিটির বর্তমান বাজার মূল্য দুই কোটি টাকার কম নয়। অন্যদিকে দুই বছর আগে এনবিআরের এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামের দেড় লাখ বাড়ির মালিকের টিআইএন নেই, তাঁরা কোনো কর দেন না।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে ১৩ লাখ টিআইএনধারী রিটার্ন জমা দিয়েছেন। দেশে প্রায় ৩০ লাখ টিআইএনধারী আছেন।