স্থানীয় শিল্পে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার চাই

আগামী ৩ জুন নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার দিন চূড়ান্ত করা হয়েছে। করোনাকালের দ্বিতীয় বাজেট এটি। করোনায় বিপর্যস্ত অর্থনীতি, বাড়ছে দারিদ্র্য, কমেছে কর্মসংস্থান। এত সব সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি অর্থনীতি পুনরুদ্ধারই বড় চ্যালেঞ্জ এবারের বাজেটে। ব্যবসায়ীরাও তাঁদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে চেয়ে আছেন অর্থমন্ত্রীর নতুন বাজেটের দিকে। আগামী বাজেট কেমন হওয়া চাই—এ নিয়ে কথা বলেছেন বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃত্বে থাকা ছয়জন ব্যবসায়ী নেতা।

রিজওয়ান রাহমান

সাধারণত বাজেট প্রণয়নের মূল কাজ জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। পরের মাসগুলোতে অল্প কিছু বিষয় সংযোজন-বিয়োজন করা হয়। গত বছরের মার্চে দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছিল। ফলে গতবারের বাজেট পুরোপুরি করোনাকেন্দ্রিক হয়নি। শেষ মুহূর্তে কিছু বিষয় যুক্ত করা হয়েছিল। চলতি বছর আমি আশাবাদী, অর্থ মন্ত্রণালয় মহামারি মোকাবিলা ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে পুরোপুরি করোনাকেন্দ্রিক বাজেট করবে।

আমাদের জন্য বর্তমান সময়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে স্বাস্থ্য খাত। এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বিশেষ বরাদ্দ দিতে হবে। সেই বরাদ্দ কার্যকরভাবে খরচ করার বিষয়টিও সরকার নিশ্চিত করবে বলে প্রত্যাশা করি। স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণের পর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখা ও বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য স্বাস্থ্য খাতকে আরেকটু ওপরের দিকে নিতেই হবে। এ জন্য বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে হবে। শুধু নগরে নয়, গ্রামীণ এলাকায়ও স্বাস্থ্য খাতের বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ জন্য প্রণোদনা ও কর অবকাশের মতো সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতে বিদেশি বিনিয়োগও আসতে দেওয়া উচিত।

দেশে ব্যবসায়ীর তুলনায় এমবিএ ডিগ্রিধারীদের সংখ্যা অনেক বেশি। তাই শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ কর্মী গড়ে তুলতে কিছু কিছু বরাদ্দ রাখা দরকার বাজেটে। অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তিতে আমরা এগোচ্ছি। কিন্তু আরও বেশি দ্রুত এগোতে হবে। বর্তমানে আমাদের রোবটচালিত যন্ত্রপাতি পরিচালনার জন্য দক্ষ লোকবল দরকার। সে কারণে কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও ডিজিটাল ব্যবস্থাপনায় উন্নতির জন্য কোম্পানি ৫ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগ করলে সেটিকে করমুক্ত ঘোষণা করা প্রয়োজন। আসছে বাজেটে এমন উদ্যোগ থাকবে বলে প্রত্যাশা করি।

করোনায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাঁদের ডিজিটাল ব্যবস্থায় নিতে হবে। আলিবাবা, আমাজনের মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে ঘরে বসে কীভাবে ব্যবসা করা যায়, সেটি তাঁদের শেখাতে হবে। কারণ, আজকাল সবাই অভিযোগ করছে, খুচরা বিক্রি কমছে। অনলাইনে বিক্রি বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই। সব মিলিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ডিজিটাল ব্যবস্থায় রূপান্তরে উৎসাহ দিতে বাজেটে প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণসহায়তা দেওয়ার বিষয়টি সহজ করার ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাকে (এনজিও) অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।

করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমিয়ে আনতে হবে। সে জন্য আগামী তিন বছর আড়াই শতাংশ করে কর কমানোর প্রস্তাব দিয়েছি। সেটি হলে তিন বছর পর করপোরেট করহার ২৫ শতাংশে নেমে আসবে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর আমাদের ব্যবসার খরচ বাড়বে। তাই আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। ধাপে ধাপে করপোরেট কর কমিয়ে আনতে পারলেই আমরা প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকব।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) বলতে চাই, রাজস্ব বাড়ানোর টার্গেট (লক্ষ্য) বন্ধ করুন। টার্গেট করে লাভ হবে না, বরং করজাল বাড়ান। রাজস্ব কর্মকর্তাদের শুধু কর আদায়ের জন্য দায়বদ্ধ না করে করজাল বাড়ানোর জন্য দায়বদ্ধ করতে হবে। কর্মকর্তাদের টার্গেট দেন, চলতি বছর ৫ শতাংশ কর আদায় বাড়ালে ৫ শতাংশ করজালও বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাত একটি সফল মডেল। এই মডেল অনুযায়ী চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ, হালকা প্রকৌশলসহ বিভিন্ন খাতে সমান সুযোগ-সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন। পোশাকের মতো ৫০ বছর পরিচর্যা করলে যেকোনো খাতই সফল হবে। আবার পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার ক্ষেত্রে করপোরেট কর কমানো হয়েছে। অন্য খাতের পরিবেশবান্ধব কারখানা, ভবন বা স্থাপনা থাকলে একই সুবিধা না দেওয়াটা বৈষম্য। সব মিলিয়ে স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট প্রণয়ন করতে হবে।

কালোটাকা সাদা করার বিষয়ে সরকার একধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। তবে ঢাকা চেম্বার কখনোই কালোটাকাকে সমর্থন করে না। আমি বিনীতভাবে বলতে চাই, ঢালাওভাবে আবাসন খাত ও পুঁজিবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ হলে খাতগুলো ফুলেফেঁপে উঠবে। কালোটাকা কিছু সময়ের জন্য বিনিয়োগ হওয়ায় একসময় সেই টাকা বেরিয়ে গেলে খাতটি বা বাজারে ধস নামবে। সে কারণে কালোটাকা সাদা করার সুযোগটি যদি সব সময়ের জন্য দিতেই হয় তাহলে শুধু অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্পকারখানা স্থাপন, অবকাঠামোর জন্য বন্ড ও সমুদ্র অর্থনীতিতে বিনিয়োগের জন্য।