'ভৌগোলিক নির্দেশক' পণ্য বিনিয়োগ আকৃষ্ট করে

যে কটি পণ্য বিশ্বে বাংলাদেশকে পরিচিত করেছে তার একটি মসলিন। মসলিনেরই টিকে যাওয়া একটি ধরন জামদানি। ঐতিহ্যগতভাবে জামদানি বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য। দেশে-বিদেশে এর গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণও রয়েছে।
এত কিছুর পরও ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ ২০০৯ সালে জামদানিকে তাদের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধন করেছে। এর নাম দিয়েছে ‘উপাদ্দা জামদানি’। অথচ, বাংলাদেশ এখনো নিজেদের জামদানিকে জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনই করতে পারেনি।
গবেষণায় উঠে এসেছে, বিশ্বব্যাপী ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের চাহিদা যেমন ভালো, তেমনি এর জন্য বাড়তি দাম দিতেও রাজি থাকেন ক্রেতারা। বিভিন্ন দেশে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি দাম দিয়ে এসব পণ্য কেনেন ক্রেতারা। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জিআই পণ্য নিবন্ধিত হলে ওই পণ্যকে ঘিরে প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগও আসে। এসব সুযোগ নিতে পারে বাংলাদেশও।
ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য নিয়ে বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের (বিএফটিআই) করা এক গবেষণায় এমন তথ্যই এসেছে। রাজধানীর মতিঝিলে ঢাকা চেম্বার মিলনায়তনে এক সেমিনারে আজ বৃহস্পতিবার গবেষণাটি তুলে ধরা হবে।
গবেষণাটি করেছেন ইউএসএআইডির বাংলাদেশ ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন অ্যাকটিভিটির শুল্কবিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ আবু ইউছুফ ও বিএফটিআইয়ের গবেষক শেখ রুখসানা বোরহান।
গবেষণাটি যখন শুরু করার সময় আবু ইউছুফ বিএফটিআইয়ের জ্যেষ্ঠ গবেষক ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের অনেক ইউনিক পণ্য আছে। এসব পণ্য জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন করা গেলে বেশ কিছু সুবিধা পাওয়া যাবে। যেমন ওই পণ্যের ওপর বাংলাদেশের একক মালিকানা তৈরি হবে। বিশ্বে বাংলাদেশের পণ্য হিসেবে তা স্বীকৃত হবে। ফলে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিংও হবে। এসব পণ্যের বাজারসুবিধা পাওয়া যায়, ভালো চাহিদাও থাকে।’
খানিকটা হতাশা ব্যক্ত করে আবু ইউছুফ বলেন, ‘ভারত কয়েক বছরে চার শতাধিক পণ্যের জিআই নিবন্ধন করেছে। এর মধ্যে ১০-১২টি বিদেশি পণ্য। আর আমরা ২০১৩ সালে জিআই আইন করেছি। কিন্তু দুই বছরে এর একটি বিধিমালাও করতে পারিনি।’
দেশে জিআই আইন বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ হচ্ছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)। জানতে চাইলে সংস্থাটির নিবন্ধক সানোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘জিআই বিধিমালা হয়ে গেছে। ছাপার কাজও প্রায় শেষ। আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে আমরা আইনটির বাস্তবায়ন শুরু করব।’
ভালো দাম মেলে: গবেষণাটি বলছে, জিআই পণ্যের জন্য ক্রেতারা ভালো দাম দিতে রাজি থাকেন। এর ভালো উদাহরণ হলো থাইল্যান্ডে প্রতি কেজি ‘জেসমিন রাইস’ বিক্রি হয় ৩৫ বাথে। কিন্তু ‘টুং কুলা রঙ্ঘাই’ নামের জেসমিন রাইস বিক্রি হয় ৪৫ বাথে। আবার পর্তুগালের ক্রেতারা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি দাম দিয়ে জিআই লেবেলযুক্ত অলিভ অয়েল (জলপাই তেল) কেনেন।
গবেষণায় বলা হয়, জিআই পণ্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে সই হওয়া এফটিএতে জিআই পণ্যের বাণিজ্যিক দিকটি গুরুত্ব পায়। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের শর্ত যাই হোক না কেন কোরিয়ার বাজারে জিআই নিবন্ধিত কৃষি ও পানীয় পণ্যের জন্য বাড়তি সুবিধা চায় ইইউ।
বিনিয়োগ আকৃষ্ট করে: জিআই পণ্য যেকোনো এলাকায় বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করে তারও বহু উদাহরণ গবেষণায় দেওয়া হয়েছে। যেমন ২০০১ সালে ভিয়েতনামের দ্বীপ ফু কুকের একধরনের সুস্বাদু সস ‘নুক মাম’-এর জিআই নিবন্ধন করা হয়। এ নিবন্ধন সসটির চাহিদা অনেক বাড়িয়ে দেয়। বাড়তি চাহিদার টানেই সেখানে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভার ১০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করে।
তাকিলা প্রস্তুত হয় ‘অ্যাগেভ’ নামক একধরনের উদ্ভিদ থেকে। এ অ্যাগেভের কারণেই তাকিলা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি বড় অংশ ছুটে যায় মেক্সিকোতে। অনেক প্রতিষ্ঠান সেখানে জমি কিনে স্থানীয় চাষিদের মাধ্যমে অ্যাগেভ চাষ করছেন। বিপুল বিনিয়োগও করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
পণ্য বাংলাদেশের, নিবন্ধন করেছে ভারত: জামদানির কথা আগেই বলা হয়েছে। পাশাপাশি নকশিকাঁথা ও ফজলি আম নিজেদের নামে জিআই নিবন্ধন করেছে ভারত। গবেষণায় বলা হয়, শুধু ফজলি আমেরই দুই দেশের ঐতিহ্য রয়েছে। বাকি পণ্যের উৎপত্তি বাংলাদেশে।
গবেষণাটি বলছে, বাংলাদেশকে জিআই নিবন্ধনে ভালো করতে হলে এ ক্ষেত্রে গবেষণা বাড়াতে হবে। বিভিন্ন পণ্যের ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও সংরক্ষণে নজর দিতে হবে। বিশেষ করে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতে হবে। পণ্যের জিআই নিবন্ধনের জন্য যথাযথভাবে তথ্য-উপাত্তসহ তাদেরই ডিপিডিটিতে আবেদন করতে হবে।

ভালো দাম মেলে
থাইল্যান্ডে প্রতি কেজি ‘জেসমিন রাইস’ বিক্রি হয় ৩৫ বাথে। কিন্তু জিআই নিবন্ধিত ‘টুং কুলা রঙ্ঘাই জেসমিন রাইস’-এর দাম ৪৫ বাথ
পর্তুগালের ক্রেতারা ৩০% বাড়তি দামে জিআই লেবেলযুক্ত অলিভ অয়েল কেনেন
আনে বিদেশি বিনিয়োগ
ভিয়েতনামের দ্বীপ ফু কুকের সস ‘নুক মাম’-এর জিআই নিবন্ধনের পর সেখানে ইউনিলিভার ১০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করে
মেক্সিকোর বিখ্যাত অ্যাগেভের কারণে তাকিলা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। তারা ২৪ হাজার চাষি ও কৃষিশ্রমিকের কর্মসংস্থান করেছে