কাজুবাদামে আপ্যায়ন বাড়ছে, তিন বছরে উৎপাদন দ্বিগুণ
প্রতি কেজি কাজুবাদাম বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকায়। তিন বছরের ব্যবধানে আবাদের পরিমাণ ও উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে। বাজারে চাহিদা আরও বেশি।
বাসাবাড়িতে সকাল কিংবা বিকেলের হালকা নাশতার সময় টেবিলে জায়গা করে নিয়েছে কাজুবাদাম। এমনকি সরকারি-বেসরকারি অফিস ও ব্যবসায়িক বৈঠকের ফাঁকেও কাজুবাদাম দিয়ে আপ্যায়নের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। ঘরের খাবার টেবিল থেকে করপোরেট অফিসে এখন কাজুবাদামের চল হয়ে গেছে। কাজুবাদামে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন এবং বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও খনিজ। সেই সঙ্গে উপকারী চর্বি ও ঔষধি গুণ থাকায় কোভিড শুরুর পর থেকে পণ্যটির চাহিদা বাড়ছে। ফলে হাজার কোটি টাকার বাজার তৈরি হয়েছে। কাজুবাদামের প্রায় ৯০ শতাংশ চাহিদা মেটাতে হচ্ছে আমদানির মাধ্যমে।
উৎপাদন বাড়ছে
দেশে কাজুবাদামের চাহিদা দ্রুত বাড়লেও উৎপাদন বাড়ছে ধীরে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে কাজুবাদাম আবাদ হয়েছিল ২ হাজার ২১ হেক্টর জমিতে। আর উৎপাদন হয়েছিল ১ হাজার ৬১৬ টন। তবে তিন বছরের ব্যবধানে আবাদের পরিমাণ ও উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে। তবে চাহিদা রয়েছে আরও বেশি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে আবাদের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৩১৭ হেক্টর। আর উৎপাদন হয়েছিল ৩ হাজার ৯৫ টন। কাজুবাদামের উৎপাদন নিয়ে কথা হয় ‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের’ পরিচালক শহিদুল ইসলামের সঙ্গে।
শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাজুবাদাম উৎপাদনে তেমন একটা যত্নের প্রয়োজন হয় না। একবার গাছ লাগালে হয়ে যায়। তা ছাড়া কাজুবাদামের মতো উচ্চ মূল্যের ফলন কমই আছে। এক কেজিতে কৃষক ২০০ টাকা পাচ্ছেন। কিন্তু পাহাড়ে এক কেজি আম থেকে হয়তো মাত্র ৪০ টাকা পাওয়া যায়। তাই পাহাড়ি কৃষকেরা কাজুবাদাম ফলনে আকৃষ্ট হচ্ছেন। আমরা তাঁদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। বিনা মূল্যে চারা দিচ্ছি। এখন কাজুবাদাম চাষ সাড়ে ৪ হাজার হেক্টরে উন্নীত হয়েছে। তবে পাহাড়ের এক লাখ হেক্টর জমিতে কাজুবাদাম চাষ করা সম্ভব।’
দরদাম কত
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে বর্তমানে কাজুবাদামের বাজার ৯০০ কোটি থেকে ১ হাজার কোটি টাকার। যেখানে স্থানীয় উৎপাদন মাত্র ১০০ কোটি টাকার। বাকি ৮০০-৯০০ কোটি টাকার বাদাম আমদানি করতে হয়। বছরে আড়াই হাজার টন থেকে তিন হাজার টন কাজুবাদাম আমদানির প্রয়োজন হয়, যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
এদিকে রোববার কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতি কেজি কাজুবাদাম বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৭৫০ টাকায়। আর ভাজা বাদামের দাম ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকায়। যদিও দু–এক বছর আগেও প্রতি কেজি কাজুবাদামের দাম ছিল ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে বিক্রেতারা বলছেন, আমদানিনির্ভর হওয়ায় ডলারের দাম বাড়ায় কাজুবাদামের দামও বেড়েছে।
কৃষক প্রতি কেজি কাঁচা বাদামের দাম পান ১৮০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। আর ৫ কেজি কাঁচা বাদাম থেকে ১ কেজি প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম পাওয়া যায়। অর্থাৎ প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিগুলো ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায় ১ কেজি বাদাম কিনে থাকে। পরে কয়েক দফা প্রক্রিয়াকরণের পর তা ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়।
বাদাম যেভাবে প্রক্রিয়াজাত হয়
ষাটের দশক থেকে পাহাড়ে কাজুবাদামের চাষ হলেও প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির যন্ত্রপাতি সহজলভ্য ছিল না। তাই বাণিজ্যিকভাবে চাষে উৎসাহিত হননি কৃষকেরা। কিন্তু লাভজনক হওয়ায় গত কয়েক বছরে দেশে ২২টি বাদাম প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যার মধ্যে নিয়মিত উৎপাদনে আছে ১৫টি প্রতিষ্ঠান। যাদের ১০–১২ হাজার টন বাদাম প্রক্রিয়ার সক্ষমতা রয়েছে। লাভজনক হওয়ায় বড় করপোরেট গ্রুপগুলোও এ ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহায়তায় বান্দরবানে ২০১৯ সালের দিকে প্রক্রিয়াকরণ শুরু করে কিষাণঘর অ্যাগ্রো। প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ প্রতিষ্ঠান মাসে ১০–১২ লাখ টাকার কাজুবাদাম বিক্রি করছে। মূলত বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান এবং বিস্কুট ও আইসক্রিম কোম্পানিগুলোর কাছেই তারা বাদাম বিক্রি করছে। ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে এসব বাদাম।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. তারিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বাদাম আকারে ছোট হওয়ায় প্রথমে কেউ কিনতে চাইতেন না। মূলত কৃষক কোনো সার ব্যবহার না করায় বাদামের আকার ছোট হয়। তাই তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতন করতে শুরু করলাম। প্রথমে ১২০ জন কৃষক নিয়ে শুরু করলেও এখন ৯৫০ জন কৃষক বাদাম উৎপাদনে কাজ করছে। ভবিষ্যতে বাদামের ব্যাপক সরবরাহ পাওয়া যাবে। আশা করছি, আমরা রপ্তানিতেও যেতে পারব।’
কী কাজে লাগে
কাজুবাদামে থাকা ফসফরাস, ভিটামিন ই ও বি, ফলিক অ্যাসিড হৃদ্রোগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। কাজুবাদামে ওলিসিক অ্যাসিড নামে একধরনের ফ্যাটি অ্যাসিড আছে, যা খারাপ কোলেস্টেরল কমিয়ে দেয়। হৃদ্রোগসহ হার্ট অ্যাটাক থেকে রক্ষায় সহায়তা করে। কাজুবাদামের ক্যালসিয়াম, কপার, জিংক ও ম্যাগনেশিয়াম হাড়কে শক্ত ও মজবুত করে। ফসফরাস দাঁতের বৃদ্ধি ঘটায়। দাঁতকে শক্ত ও সুন্দর করে। হাড় ও দাঁতের গঠনে সাহায্য করে।