দক্ষিণ এশিয়ায় খেলাপি ঋণের হার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাংলাদেশে

দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে খেলাপি ঋণের হার কমলেও বাংলাদেশে বাড়ছে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দুর্দশায় থাকা শ্রীলঙ্কায় খেলাপি ঋণের হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। অন্য দেশগুলোতে কম। এমনকি পাকিস্তানেও খেলাপি ঋণের হার বাংলাদেশের চেয়ে কম। সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় খেলাপি ঋণের হার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাংলাদেশে।

বাংলাদেশ ব্যাংক গত রোববার খেলাপি ঋণের হালনাগাদ পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, দেশে খেলাপি ঋণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। জুন শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা এপ্রিল-জুন সময়ে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা বেড়েছে। 

বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে মোট ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। অর্থনৈতিক সংকটে থাকা শ্রীলঙ্কায় খেলাপি ঋণের হার ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। পাকিস্তানে তা ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। 

ভারতে খেলাপি ঋণের হার অনেক কম। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ভারতে খেলাপি ঋণের হার ৩ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) ধারণা হলো, ভারতে আগামী বছর খেলাপি ঋণের হার ৩ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসবে। 

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ভারতসহ অনেক দেশ খেলাপি ঋণের রাশ টেনে ধরতে পেরেছে। দেউলিয়া আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নজরদারির মাধ্যমে তারা এটা করতে পেরেছে। বাংলাদেশেও খেলাপি ঋণের রাশ টানতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। 

আরও পড়ুন

দক্ষিণ এশিয়ার চিত্র

বিশ্বব্যাংক
ফাইল ছবি

বিশ্বব্যাংক বিভিন্ন দেশে খেলাপি ঋণের হিসাব তাদের ওয়েবসাইটে তুলে ধরে। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার নিয়মিত বাড়ছে। যেমন ২০১৩ সালে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৪ দশমিক ৮ শতাংশ; পরের বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালে তা একলাফে ৯ দশমিক ৪ শতাংশে উঠে যায়। 

বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি দাঁড়ায় ২০১৮ সালে। এরপর কিছুটা কমে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, এখন আবার খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। 

ভারতে খেলাপি ঋণের চিত্রও আছে বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে। তাদের হিসাবে, ২০১৭ সালে ভারতের খেলাপি ঋণ ছিল মোট ঋণের ১০ শতাংশ, যা কমতে কমতে ২০২১ সালে সাড়ে ৬ শতাংশে নামে। 

বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) পাকিস্তানে খেলাপি ঋণ ছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। উল্লেখযোগ্য দিক হলো, দুর্দশার মধ্যেও দেশটিতে খেলাপি ঋণ কমেছে। আগের বছরের একই সময়ে পাকিস্তানে খেলাপি ঋণ ছিল ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। 

নেপালের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, দেশটিতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, তবে হার এখনো কম। সেটা ৩ শতাংশের আশপাশে। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে মালদ্বীপের খেলাপি ঋণ ছিল ৬ শতাংশের কম। ভুটানের ক্ষেত্রে এই হার ছিল ৮ শতাংশের নিচে। 

উন্নয়নশীল দেশে কী অবস্থা

বিশ্বব্যাংকের তথ্যভান্ডার থেকে দেখা যায়, ২০২২ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ব্রাজিলের খেলাপি ঋণের হার ছিল ২ দশমিক ৬ শতাংশ। এ ছাড়া ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে একই সময়ে রাশিয়ার খেলাপি ঋণের হার ছিল ৬ দশমিক ১ শতাংশ। দক্ষিণ আফ্রিকার খেলাপি ঋণ ছিল ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। একই বছর ভিয়েতনামের খেলাপি ঋণ ছিল ১ দশমিক ৬ শতাংশ। 

আর্জেন্টিনার অর্থনৈতিক দুর্দশার কথা সুবিদিত। দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার অনেক বেশি। দুর্দশায় পড়ে আর্থিক সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছেও তারা গেছে সবচেয়ে বেশিবার। কিন্তু তাদের খেলাপি ঋণের হারও বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম; ২০২২ সালে যা ছিল ৩ দশমিক ১ শতাংশ। 

উন্নত দেশগুলোর মধ্যে ২০২২ সালে যুক্তরাজ্যের খেলাপি ঋণের হার ছিল ১ শতাংশ; যুক্তরাষ্ট্রের ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, উন্নত দেশগুলোর তুলনায় উন্নয়নশীল ও অস্থিতিশীল দেশগুলোতে খেলাপি ঋণের হার বেশি। 

আর্থিক খাতের ঝুঁকি  

বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে ২০২২ সালে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘চেঞ্জ অব ফেব্রিক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি দেশের আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এতে দেশের উৎপাদনশীল খাতে অর্থায়ন ব্যাহত হচ্ছে। 

বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এরা নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়। তবে পরিচালনাসংক্রান্ত দুর্বলতার কারণে তারা বেসরকারি খাতে দক্ষতার সঙ্গে ঋণ বিতরণ করতে পারছে না। 

মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ও বিনিয়োগের হারের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ১ শতাংশীয় বিন্দু বাড়লে মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক ১৩ শতাংশীয় বিন্দু বাড়ে। বিনিয়োগ বাড়লেও মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হয়। তবে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে দেশে জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। 

বাংলাদেশ যদি ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের কাতারে উঠতে চায়, তাহলে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। 

সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে হিসাব করা হলে বাংলাদেশে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি হবে। সেই সঙ্গে মামলার কারণে বিভিন্ন ব্যাংকের প্রায় এক লাখ কোটি টাকার মতো আটকে আছে। এতে দেশে যেমন বিনিয়োগযোগ্য অর্থ কমছে, তেমনি ব্যাংকের মুনাফাও কমছে। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা দুর্বল হচ্ছে।