ত্রিবেনীপুলের তবলা বাজে সারা দেশে

তবলা-বায়া, খোল, নাল কত সব বাদ্যযন্ত্র। শত বছরের বেশি সময় ধরে নারায়ণগঞ্জের বন্দরের সোনাকান্দা এলাকার ত্রিবেনীপুল এলাকায় এসব তৈরি হচ্ছে। তবে এখানকার তবলা–বায়ার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। সারা দেশ তো বটেই, এখানকার তবলা বাজে পার্শ্ববর্তী দেশের কলকাতায়ও। অনেক শিল্পী সরাসরি এখান থেকে বাদ্যযন্ত্র বানিয়ে নিয়ে যান।

বাদ্যযন্ত্র কারিগরেরা জানিয়েছেন, তবলা-বায়া, খোল, নাল, পাখোয়াজ, ঢোল, ঢোলক, ঢোলকি, খঞ্জরি, ঘুমোট, কঙ্গ, বঙ্গ, বিগ ড্রাম, চাই ড্রাম, তরকা, খমকসহ অর্ধশতাধিক ধরনের বাদ্যযন্ত্র তৈরি হয় ত্রিবেনীপুল এলাকায়। বংশপরম্পরায় এসব বাদ্যযন্ত্র তৈরি করে আসছেন অনেকে। এখানে তৈরি তবলা–বায়াসহ বাদ্যযন্ত্র ছায়ানট, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, সায়েন্স ল্যাবরেটরিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়।

৩০ বছর ধরে বাদ্যযন্ত্র তৈরির সঙ্গে যুক্ত সুজন চন্দ্র দাস। ত্রিবেনীপুলের নির্মল মিউজিক সেন্টারের এই কারিগর বছরের ১২ মাস তবলা–বায়া তৈরি করেন। সুজন প্রথম আলোকে বলেন, তবলা–বায়ার জন্য ত্রিবেনীপুল বিখ্যাত। এখানকার তবলা–বায়ার কদর সারা দেশে, চাহিদাও বেশি। দেশের বিভিন্ন স্থানের শিল্পীরা এখান থেকে অর্ডার দিয়ে তবলা বানিয়ে নিয়ে যান। এখানকার কারিগরেরা প্রতি সপ্তাহে ২০ থেকে ৪০টা তবলা–বায়া তৈরি করতে পারেন।

তবলা–বায়া তৈরিতে উৎপাদনভিত্তিক মজুরি দেওয়া হয়। প্রতিদিন ৩০০ টাকা থেকে শুরু করে ৭০০ টাকা পাওয়া যায়। দুই হাত দেখিয়ে সুজন বলেন, ‘তবলা–বায়ার চামড়ার ফিতা টানতে টানতে হাতে ফোসকা পড়তে পড়তে কড়া পড়ে গেছে। কষ্ট অনুযায়ী কাজের মূল্যায়ন নেই, টাকা নেই। সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়।’

ত্রিবেনীপুল এলাকায় বাদ্যযন্ত্রের দোকান আছে চারটি। এসব দোকান কারিগর আছেন প্রায় ২০ জন। এ ছাড়া বাড়িতেও অনেকে বাদ্যযন্ত্র তৈরি করেন। তবে উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাদ্যযন্ত্র বানিয়ে লাভ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

লোকনাথ যন্ত্রসংগীতের মালিক স্বপন কুমার দাস। ৪৫ বছর ধরে এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত তিনি। স্বপন বলেন, তাঁর বাবা ও ঠাকুরদাদা এই কাজ করেছেন। তাঁরাও বংশপরম্পরায় এই কাজ করছেন। বর্তমান সময়ে এই ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন জানিয়ে স্বপন বলেন, সব জিনিসের দাম বেড়েছে। চামড়া, পিতল, তামা ও কাঠের দাম বেড়েছে। বাড়িভাড়া বাড়ছে, শ্রমিকের মজুরি বাড়ছে, পরিবহন ভাড়া বাড়ছে কিন্তু তাঁদের বাদ্যযন্ত্রের দাম বাড়েনি। সে কারণে তাঁরা বাদ্যযন্ত্র তৈরি করে ভালো দাম পান না।

কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাদ্যযন্ত্র তৈরিতে যেসব উপকরণ দরকার, তার অন্যতম গরু ও ছাগলের চামড়া, নিম ও মেহগনি কাঠ। রশি, পিতল, লোহার রিং—এসবও প্রয়োজন। মানিকগঞ্জ, পলাশবাড়ী, গাইবান্ধা ও নাটোর থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় বাদ্যযন্ত্রের জন্য চামড়া সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি চামড়ার পেছনে খরচ পড়ে ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা। তবলা–বায়া তৈরির কাঠ, পিতল ও তামার ডাইস রাজধানীর জিনজিরা থেকে আনা হয়। মানিকগঞ্জ থেকে নিম ও মেহগনি কাঠ আনা হয়।

উপকরণের মানভেদে বাদ্যযন্ত্রের দাম বিভিন্ন রকম হয়। এক জোড়া তবলা–বায়ার দাম ছয় থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকা। খঞ্জরি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, পাখোয়াজ ১১ হাজার টাকা, নাল ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা, চেইঞ্জার তবলা–বায়ার দাম ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।

নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক শাহীন মাহমুদ বলেন, ঐতিহ্য ধরে রেখে ত্রিবেনীপুলের বাদ্যযন্ত্রের কারিগরেরা বংশপরম্পরায় বাদ্যযন্ত্র বানিয়ে আসছেন। এসব ব্যবহার করে শিল্পীরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।