‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’: বিষয়টি কী, কবে নাগাদ হবে

প্রতীকী ছবি

মতিঝিল এলাকায় খুচরা কাপড় বিক্রি করেন মোহাম্মদ ফসিউর। অন্য অনেকের মতো তিনিও পেয়েছেন কিউআর কোড। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্যাশলেস বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগের অংশ হিসেবে কয়েক দিন আগে দেওয়া হয়েছে এই কিউআর কোড। উদ্দেশ্য, নগদ টাকা ছাড়া লেনদেন করা।

প্রথম আলোকে এই বিক্রেতা জানালেন, তাঁর বরং খানিকটা সুবিধাই হয়েছে এ ব্যবস্থায়। ‘দিনে ৩০ জন ক্রেতার মধ্যে ৩ থেকে ৪ জন কিউআর কোডের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করছে। ক্রেতারা নিজেই আগ্রহ নিয়ে এই লেনদেন করছে। এতে খুচরার ঝামেলা নেই, জালটাকারও ভয় নেই,’ বলেন তিনি।

তবে শুধু মতিঝিল নয়, এরই মধ্যে বাংলা কিউআর কোড পেয়েছেন রাজধানীর ধানমন্ডি ও কারওয়ান বাজারের অনেক খুচরা বিক্রেতা। এর মাধ্যমে তাঁরা ডিজিটাল পদ্ধতিতে বেচাকেনার টাকা পাচ্ছেন। গড়ে এখন প্রতিদিন ৭০০ থেকে ৮০০ লেনদেন হচ্ছে এসব বিক্রেতার।

ভবিষ্যতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেও একই উদ্যোগ নেওয়া হবে। ধীরে ধীরে সব ব্যাংক ও এমএফএসকে যুক্ত করে সারা দেশে এই উদ্যোগ ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ক্যাশলেস বাংলাদেশ কর্মসূচিতে ধীরে ধীরে লেনদেনের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলা কিউআর কোডে বৃহস্পতি থেকে শনিবার লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৫১২টি। রোববার ৫৬৫টি লেনদেন হয়েছে, আর বুধবারে হয়েছে ৮৬৫টি।

কর্মকর্তারা বলেন, যত বেশি লেনদেন বাড়বে, তত ভালো। মোট কত টাকার লেনদেন হলো, এটা মুখ্য বিষয় নয়।

কী চায় বাংলাদেশ ব্যাংক

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, তারা দেশের মধ্যে নগদ টাকার লেনদেন কমাতে চায় এবং এ লক্ষ্যে নানা উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার জানিয়েছেন আগামী ৪ বছরের মধ্যে ৭৫ শতাংশ লেনদেন নগদ অর্থবিহীন বা ক্যাশলেস মাধ্যমে আনার লক্ষ্যের কথা। কারণ, নগদ টাকার লেনদেন যত কম হবে, অর্থনীতির গতি তত বাড়বে এবং এটা প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।

ডিজিটাল লেনদেনকে আরও সহজ করতে বাংলা কিউআরকে প্রাধান্য দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যার ফলে লেনদেনের জন্য আগামী জুনের পর ব্যাংক এবং মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের নিজস্ব কিউআর কোড থাকবে না, শুধু বাংলা কিউআর কোড ব্যবহার হবে। আশা করা হচ্ছে, এর ফলে গ্রাহক ও বিক্রেতাদের জটিলতা কমবে।

ক্যাশলেস বাংলাদেশ উদ্যোগের আওতায় নগদ টাকার ব্যবহার কমাতে এটাই একমাত্র পথ নয় বাংলাদেশ ব্যাংকের; নগদ টাকার ব্যবহার কমাতে আগে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার-সুবিধা চালু হয়েছে। রয়েছে ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচের অধীন এটিএম, পয়েন্ট অব সেলস লেনদেন, কার্ডে লেনদেন ও ইন্টারনেট ব্যাংকিং ফান্ড ট্রান্সফার-সুবিধা। আছে রিয়েল টাইম গ্রোস সেটেলমেন্টের সুবিধাও।

এগুলো সবই ইন্টারনেট ব্যবহার করে নেওয়া ব্যাংকিং সুবিধা। এ ছাড়া বিকাশ, রকেট, নগদ, উপায়ের মতো মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসে (এমএফএস) সুবিধা লেনদেনের চিত্র বদলে দিয়েছে। পরিষেবা বিল পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ, টিকিট কেনা, শপিং মলে কেনাকাটা, অর্থ স্থানান্তর সেবা—এগুলো সাধারণ মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে।

এসব সুবিধা চালুর মাধ্যমে নগদ টাকার ব্যবহার কমে এলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইছে নগদ টাকার ব্যবহার আরও কমিয়ে আনতে। ডিজিটাল লেনদেন বাড়লে টাকা ছাপানোর খরচ কমার পাশাপাশি প্রতিটি লেনদেনের হিসাব থাকবে। আবার খুচরা টাকার ঝামেলা ও সময়ের অপচয় কমে আসার পাশাপাশি জীবন আরও স্বচ্ছন্দময় হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক প্রথম আলোকে বলেন,‘এখন বিল পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ, টিকিট কেনা, শপিং মলে কেনাকাটাসহ অনেক কিছুই অনেকটা ক্যাশলেস হয়ে গেছে। খুচরা কেনাকাটা ও খরচকে ডিজিটাল মাধ্যমে আনতে আমরা ক্যাশলেস বাংলাদেশ উদ্যোগ নিয়েছি। চলতি বছরে সারা দেশে প্রচারণা ও কার্যক্রম শুরু করা হবে। এর মাধ্যমে ধীরে ধীরে নগদ টাকার লেনদেন কমে আসবে।’

মতিঝিলের কিউআর কোডভিত্তিক ক্যাশলেস বাংলাদেশ উদ্যোগে যুক্ত হয়েছে ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, এবি, ইস্টার্ণ, ইসলামী, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল, দি সিটি, ব্যাংক এশিয়া, পূবালী এবং ওয়ান ব্যাংক। এ ছাড়া এমএফএস প্রতিষ্ঠান বিকাশ, এমক্যাশ, রকেট ও কার্ড সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান মাস্টারকার্ড, ভিসা ও অ্যামেক্স এ সেবায় যুক্ত হয়েছে।

ক্যাশলেস লেনদেন কতটা হচ্ছে

মুঠোফোনের মাধ্যমে পরিচালিত আর্থিক সেবা বা এমএফএসে এখন প্রতি মাসে লেনদেন হচ্ছে ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি। কেবল গত ডিসেম্বরেই এ সুবিধা ব্যবহার করে লেনদেন হয়েছে ৯৬ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। এ ছাড়া এটিএমে লেনদেন হয়েছে ২৯ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা, পয়েন্ট অব সেলসে ২ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা, ক্যাশ রিসাইক্লিং মেশিনে ৬ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা এবং ই-কমার্সে ১ হাজার ১৩০ কোটি টাকা।

এ ছাড়া অনলাইনে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তরিত হয়েছে মোট ২৭ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা।

এসব পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, মানুষ এরই মধ্যে ছাপানো টাকার ব্যবহার ছাড়াই অর্থ লেনদেনে কিছুটা হলেও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। গত রোববার গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার যে লক্ষ্যের কথা বলেছেন, তাতে হয়তো ২০২৭ সালের মধ্যে দেশের ৭৫ শতাংশ লেনদেনই হবে ক্যাশলেস।

দেশে এখন আমানতের পরিমাণ ১৪ লাখ ৮৯ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা। তবে ছাপানো মুদ্রা গত অক্টোবরে ছিল ৩ লাখ ৩৫ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু মানুষের হাতে ছিল ২ লাখ ৩৬ হাজার ১১৪ কোটি টাকা।

ব্যাংকিং খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকারি প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা পেলে নগদ টাকার ব্যবহার কমবে, আর মানুষ ক্যাশলেস বাংলাদেশ ধারণার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।