যুদ্ধ–সংঘাত যে প্রভাব ফেলছে মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনৈতিক উচ্চাশায়

ইসরায়েল–হামাস যুদ্ধে ইসরায়েলি ক্ষেপনাস্ত্রের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ ধ্বংসস্তূপের পাশ দিয়ে যাচ্ছে দুই শিশু।রয়টার্স

ধারণা করা হয়েছিল যে মধ্যপ্রাচ্যের গতি-প্রকৃতি এরই মধ্যে বদলে গেছে। আগের সেই মধ্যপ্রাচ্য আর নেই। এখন আগের চেয়ে অনেক নিরপেক্ষ ও শান্ত, যেখানে আরব, ইহুদি, ইরানি শিয়া, সুন্নি আরব, মার্কিন, এমনকি রুশরা একক ও অভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে সহাবস্থান করবে—এ–ই ছিল আশা। সেই একক ও অভিন্ন উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, মুনাফা।

সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত নতুন এই মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্ব দিচ্ছিল। সারা বিশ্বের বিভিন্ন কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারাও তা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু দ্য ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, নতুন এই মধ্যপ্রাচ্য গত ছয় মাসে আক্রমণের মধ্যে পড়েছে—প্রথমত, হামাস ও ইসরায়েলের সংঘাত এবং দ্বিতীয়ত, ইসরায়েল ও ইরানের সরাসরি হামলা ও পাল্টা হামলা।

কথা হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের নতুন স্বপ্ন কি এসব ঝড়ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করতে পারবে?

সুখবর হলো, ইরান ও ইসরায়েল বাহিনীর এই হামলা ও পাল্টা হামলা বৃহত্তর সংঘাতে রূপ নেয়নি। তবে গাজার যুদ্ধ ইসরায়েল-ইরানের ড্রোন নিক্ষেপের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এই যুদ্ধের ভয়াবহতা অনেক বেশি। এই যুদ্ধ আবার কেবল দুই ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—মিসর, জর্ডান ও লেবাননের মতো দেশে এর প্রভাব আছে। সে জন্য ইরান-ইসরায়েলের সংঘাত আপাতভাবে বিশেষ উদ্বেগের কারণ না হলেও মধ্যপ্রাচ্যে একধরনের উত্তেজনা বিরাজ করছে। মধ্যপ্রাচ্যের বাণিজ্যিক সম্ভাবনাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর ইসরায়েল যে যুদ্ধংদেহী অবস্থান দিয়েছে, বিশ্ববাণিজ্যে তার তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যের জলপথে। ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা গাজাবাসীর সঙ্গে সংহতি জানিয়ে লোহিত সাগরে চলাচলকারী জাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে। এ ছাড়া ১৩ এপ্রিল ইরান ওমান উপসাগর থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কিত এক বাণিজ্যিক জাহাজ জব্দ করেছে। অভিযোগ, এই জাহাজ আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা আইন লঙ্ঘনের পাশাপাশি ইরানি কর্তৃপক্ষের আহ্বানে সাড়া দেয়নি।

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কনটেইনার জাহাজ কোম্পানি এ পি মোলার-মায়ার্সক সৌদি আরব ও ওমানের বন্দরে জাহাজ ভেড়ানো বন্ধ করে দিয়েছে। এখন তারা আফ্রিকা ঘুরে জাহাজ চালাচ্ছে; এমনকি তাতে এশিয়া-ইউরোপের জাহাজ চলাচলের সময় দু–তিন সপ্তাহ বেড়ে গেলেও তারা পিছপা হচ্ছে না। সামগ্রিকভাবে জর্ডান ও সৌদি আরবে জাহাজের নোঙর করা যথাক্রমে ৬৫ শতাংশ ও ৪০ শতাংশ কমে গেছে। সুয়েজ খাল, বাব-আল মান্দাব, লোহিত সাগরের উভয় পাড় ও হরমুজ প্রণালি দিয়ে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল ৭৫ শতাংশ কমেছে।

তেলবাহী ট্যাংকারগুলোও এই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পথ এড়িয়ে চলছে। এসব পথ এড়িয়ে যাচ্ছে প্রমোদতরিগুলোও। যে পর্যটকেরা সমুদ্রসৈকত দেখলেই পাগল হয়ে যান, তাঁরা মিসর ও জর্ডান থেকে দূরে থাকছেন। অথচ এই দেশ দুটির জিডিপির ১০ থেকে ১৫ শতাংশ আসে পর্যটন থেকে। এই দেশগুলোর লক্ষ্য ছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে ১৬ কোটি পর্যটক আকর্ষণ করবে; কিন্তু সেই আশা ক্রমেই তিরোহিত হচ্ছে।

বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও এই যুদ্ধ-সংঘাতের পরোক্ষ প্রভাব অনুভব করছে। ইসরায়েলে চার শতাধিক বহুজাতিক কোম্পানির কার্যালয় আছে। সেখানকার পদস্থ নির্বাহীরা এখন শঙ্কিত, তাঁদের কর্মীদের সেনাবাহিনীর রিজার্ভ সৈন্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য কবে না ডেকে নেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রে গুগলের কর্মীরা ইসরায়েল সরকারের সঙ্গে কোম্পানির চুক্তির বিরোধিতা করছেন। এর জেরে এখন পর্যন্ত ৫০ জন চাকরি হারিয়েছেন। আরেক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম স্ন্যাপের রাজস্ব আয় কমে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। তারা বলছে, বিজ্ঞাপনদাতারা মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বিজ্ঞাপন দিতে চাইছে না। ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মালিক মেটা একই উদ্বেগ জানিয়েছে।

সেই সঙ্গে অনেক মুসলিম দেশে কোকাকোলা ও স্টারবাকসের মতো মার্কিন পণ্য বর্জনের ডাক উঠেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ম্যাকডোনাল্ডসের বেচাকেনা কমতে শুরু করেছে।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো গত পাঁচ বছরে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বেশ সফল হয়েছে। মিসর, ওমান, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশে এই সময়ে বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছিল। কিন্তু সেখানেও এখন ভাটা দেখা যাচ্ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মধ্য মার্চ পর্যন্ত এই দেশগুলোয় বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ১০০ কোটি ডলারের মতো, ২০২১ সালে প্রতি প্রান্তিকে যেখানে আসত গড়ে ৪৭০ কোটি ডলার।

তবে সবাই যে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, তা নয়; এর মধ্যেও মধ্যপ্রাচ্যে অ্যামাজন ও মাইক্রোসফটের ক্লাউড কম্পিউটিং ব্যবসার বড় ধরনের সম্প্রসারণ হচ্ছে।

সামগ্রিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ব্যবসায় উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এই সংঘাত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না গেলেও তার আঁচে এই অঞ্চলের শাসকেরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে অর্থ ঢালতে পারেন নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার নিশ্চিত করার পেছনে। এটা আগেও হয়েছে। কিন্তু এখন সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে ধারা তৈরি হয়েছে, আগে তা ছিল না।