দেশে বিদেশি কোম্পানির কারখানা স্থাপন কমেছে

গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগ কমে যাওয়ার অর্থ হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর সক্ষমতার বিকাশ ব্যাহত হওয়া।

কারখানা
প্রতীকী ছবি

দেশে গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগ বা বিদেশি কোম্পানির শাখা বা কারখানা খোলা বাবদ বিনিয়োগ অনেকটাই কমেছে। ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আঙ্কটাড) প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২২ সালের প্রথম ১১ মাসে দেশে এই বিনিয়োগ কমেছে ৫৯ শতাংশ।

একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রকল্প অর্থায়নবিষয়ক বিনিয়োগও বিপুল হারে কমেছে। ২০২২ সালে এ-বিষয়ক বিনিয়োগ কমেছে ৯৭ শতাংশ। গত বছর এ-বিষয়ক চুক্তি হয়েছে মাত্র একটি।

আঙ্কটাডের প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ২০২০ সালে দেশে গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগ এসেছিল ৭৯ কাটি ৫০ লাখ ডলারের। পরের বছর, অর্থাৎ ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার। কিন্তু ২০২২ সালের প্রথম ১১ মাসে তা নেমে আসে ৩৭ কোটি ৬০ লাখ ডলারে। অর্থাৎ এ সময়ে গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগ কমেছে ৫৯ শতাংশ।

আঙ্কটাড বলছে, এ ধরনের বিনিয়োগ কমে যাওয়া উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ক্ষতিকর। কারণ, এই বিনিয়োগ উন্নয়নশীল দেশের অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণে অত্যন্ত সহায়ক। এই বিনিয়োগ কমে যাওয়ার অর্থ হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর সক্ষমতার বিকাশ ব্যাহত হওয়া।

২০২০ সালে আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৬৭ দশমিক ৮ কোটি ডলার। ২০২১ সালে যা ৪৩৪ দশমিক ৫ কোটি ডলারে উন্নীত হলেও ২০২২ সালে তা ১১ দশমিক ৭ কোটি ডলারে নেমে আসে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে অর্থ আসা কমেছে ৯৭ শতাংশ। ২০২১ সালে এ-বিষয়ক চুক্তি হয়েছিল ১৪ টি, ২০২২ সালে যা ১ টিতে নেমে আসে।

এই হতাশাজনক চিত্র অবশ্য কেবল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয়, সামগ্রিকভাবে এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর ক্ষেত্রেই দেখা গেছে। প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে আঙ্কটাড বলেছে, ২০২২ সালে এলডিসিভুক্ত দেশগুলোতে এফডিআই বা প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৩০ শতাংশ, যদিও সামগ্রিকভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তা কিছুটা বেড়েছে। বলা হয়েছে, চলমান বৈশ্বিক সংকটের অভিঘাতে বিনিয়োগ কমেছে। বিশেষ করে জ্বালানি ও খাদ্যসংকট এবং আর্থিক ও ঋণসংকটের কারণে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহ কমে গেছে।

তথ্যানুসারে, ২০২২ সালে বিশ্বের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগ চুক্তি কমেছে ৪২ শতাংশ আর অর্থমূল্যে তা কমেছে ৪০ শতাংশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু এফডিআই নয়, সব ধরনের আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ কমেছে। দরিদ্র দেশগুলোর অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ হয় আন্তর্জাতিক প্রকল্প অর্থায়ন (আইপিএফ) থেকে। কিন্তু দেখা গেছে, ২০২২ সালে আইপিএফ-বিষয়ক চুক্তি কমেছে ৪২ শতাংশ আর অর্থমূল্যে তা কমেছে ৭৬ শতাংশ।

গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগ কমে যাওয়া

গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগ কমে যাওয়ার সঙ্গে বৈশ্বিক পরিস্থিতির সম্পর্ক আছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত বছর বিশ্বজুড়েই একধরনের অনিশ্চয়তা ছিল। সেই সঙ্গে ডলারের দর ঊর্ধ্বমুখী থাকার কারণেও ডলারে বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে। ফেডারেল রিজার্ভ সাতবার নীতি সুদহার বৃদ্ধি করায় সে দেশে বন্ডের সুদহার বেড়েছে। ফলে পৃথিবীর অনেক বিনিয়োগকারী বন্ডে বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন।

এর সঙ্গে দেশের ব্যবসার পরিস্থিতির সম্পর্কও আছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। জমি, পরিষেবা, প্রয়োজনীয় অনুমোদন-এসব প্রাপ্তি সহজ করা না গেলে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা কঠিন বলেই মনে করেন তাঁরা।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সেলিম রায়হান বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের দিকেও তাকাতে হবে। ২০২০ সালের পর ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ভালো করলেও বাংলাদেশ ঠিক পারছে না। তাঁর মনে হয়, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এক জায়গায় আটকে গেছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর বাস্তবায়ন গতি হারিয়েছে। বিডা ও বেজার মতো প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন দেশকে তুলে ধরতে পারছে না, তেমনি নিজেদেরও তুলে ধরতে পারছে না। এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ব্যবসার পরিবেশ, ব্যয়, রাজনৈতিক ভারসাম্য-এসব বিষয় বিবেচনা করে।

সেই সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগের সঙ্গে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন সেলিম রায়হান। অস্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা স্বস্তি বোধ করেন না। বিশেষ করে রিজার্ভ কমে গেলে তাঁদের মনে শঙ্কা সৃষ্টি হয়, এখান থেকে লভ্যাংশ নিয়ে যাওয়া কঠিন হবে। এই শঙ্কার কারণেও দেশে নতুন বিনিয়োগ কমে গেছে বলে তিনি মনে করেন।

জানা গেছে, সম্প্রতি আইএফসির এক অনুষ্ঠানে বিদেশি বিনিয়োগ বিষয়ক এক নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান বিষয়ের বাইরে গিয়ে নিজের অতীত কর্মকাণ্ডের গুণকীর্তন করেন। অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ হাইকমিশনার উপস্থিত ছিলেন। এই ঘটনা উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে বিস্ময় উদ্রেক করে।