আমদানি কমলেও ডলার–সংকট কাটছে না

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পাচার বন্ধ না হওয়ায় সংকট দূর হচ্ছে না। ডলারের দামের কারণে প্রবাসী আয় কমেছে, ফলে রিজার্ভও কমেছে।

দেড় বছর আগে শুরু হওয়া ডলার–সংকট এখনো কাটেনি, মুদ্রাবাজারের অস্থিরতাও যায়নি। যে কারণে আমদানিকারকেরা এখনো চাহিদামতো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না, যদিও সরকারের কড়াকড়িতে আমদানি কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ। তবে ব্যাংকগুলোতে ডলারের মজুত কিছুটা বেড়েছে। এক বছরে চলতি হিসাবের ঘাটতি প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার কমেছে। কবে নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, সেই সম্ভাবনার আশ্বাস বা আভাসও কেউ দিতে পারছেন না।

জানা গেছে, এখনো অনেক ব্যাংকের বিদেশি আমদানি দায় মেয়াদোত্তীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। দেশ থেকে অর্থ পাচার অব্যাহত থাকায় ডলারের প্রবাহ চাহিদামতো বাড়ছে না। রপ্তানিকারকেরাও পণ্য রপ্তানির আয় সময়মতো দেশে আনছেন না। আর ঋণপত্র খোলার জন্য প্রভাবশালী ও বড় ব্যবসায়ীদের যে চাহিদা রয়েছে, তাতে অন্যরা সুযোগই পাচ্ছেন না। ফলে সংকটও কাটছে না।

এসব নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বিভিন্নভাবে ডলারের উৎসগুলো সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। বিদেশি ব্যাংকগুলোও আগের মতো সমর্থন দিচ্ছে না। ডলারের কম দামের কারণে সব প্রবাসী আয় বৈধ পথে আসছে না। অর্থ পাচারও অব্যাহত রয়েছে। আবার ডলারের দামও পুরোপুরি বাজারভিত্তিক হচ্ছে না। অন্যান্য দেশ যেভাবে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার পরিচালনা করে, বাংলাদেশকেও সেই পথে যেতে হবে। কারণ, ডলার বাজারের পরিস্থিতি অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কিত। না হলে সংকট আরও দীর্ঘায়িত হবে, মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে।’

আমদানি ও প্রবাসী আয়

ডলারের প্রধান চাহিদা আমদানি দায় পরিশোধে। এর পাশাপাশি প্রযুক্তি, চিকিৎসা, বিমান পরিবহন, বিদেশি ঋণসহ নানা খাতে ডলার খরচ হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডলার–সংকট নিরসনের চেষ্টা করে যাচ্ছে।

রাজধানীর কয়েকটি ব্যাংক শাখা ঘুরে দেখা গেছে, এখন আর তাদের কাছে গেলেই ঋণপত্র খোলা যায় না। তবে যাঁরা বড় রপ্তানিকারক, তাঁদের ঋণপত্র খোলা অব্যাহত আছে। পাশাপাশি খাদ্য, জ্বালানি ও তেল আমদানির ঋণপত্র খুলছে। অথচ ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা চাহিদামতো ঋণপত্র খুলতে পারছেন না।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ব্যাংকগুলো প্রতিদিন প্রায় সাড়ে তিন হাজার ঋণপত্র খুলছে, যার মূল্য যাচাই করে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। এদিকে চাহিদামতো ডলার না পাওয়ায় সার্বিকভাবে ঋণপত্র খোলা কমে গেছে। গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর—তিন মাসে ঋণপত্র খোলা হয়েছে ১ হাজার ৫৮৯ কোটি ডলারের, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ শতাংশ কম। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮ হাজার ৯১৬ কোটি ডলারের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি খরচ কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ। এখন আমদানি কমলেও এক বছর আগে যেসব আমদানি হয়েছিল, তার দায় এখন শোধ করতে হচ্ছে। যে কারণে সংকট কাটছে না।

দেশে ডলারের সবচেয়ে বড় জোগান আসে প্রবাসী আয় থেকে। কারণ, প্রবাসীদের বৈধ পথে পাঠানো আয়ের পুরোটাই তাৎক্ষণিকভাবে দেশে চলে আসে। আর রপ্তানি আয়ের বড় অংশই আমদানি দায় পরিশোধে খরচ হয়ে যায়।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে প্রায় ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে প্রবাসী আয় আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ কমেছে।

এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে ব্যাংকগুলো এখন প্রতি ডলারে বাড়তি আড়াই শতাংশ পর্যন্ত প্রণোদনা দিচ্ছে। ফলে প্রবাসী আয়ে সরকারি প্রণোদনাসহ প্রতি ডলারে ১১৫ টাকা দাম পাচ্ছেন প্রবাসীদের আত্মীয়স্বজনেরা। ফলে সামনে প্রবাসী আয় বাড়বে বলে আশা করছেন ব্যাংকাররা।

ব্যাংকগুলো এখন রপ্তানি আয় নগদায়নে প্রতি ডলার ১১০ টাকা দিচ্ছে এবং আমদানি দায় পরিশোধে আনুষ্ঠানিকভাবে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা দাম আদায় করছে।

মজুত, চলতি হিসাব ও ঋণপত্র

বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা উদ্যোগের ফলে আমদানি কমার প্রভাব পড়েছে দেশের চলতি হিসাবে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ১ হাজার ৮৬৩ কোটি ডলার, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে কমে ৩৩৩ কোটি ডলার নেমেছে। এদিকে বাজারে বৈদেশিক তারল্য বেড়ে ৩৫০ কোটি ডলারে উঠেছে, যা এক বছর আগে ঋণাত্মক অবস্থায় ছিল।

এদিকে ব্যাংকগুলোতেও নগদ ডলারের মজুত বেড়ে ৩ কোটি ২০ লাখ ডলার হয়েছে। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত কমে ২ হাজার ৬৬৮ কোটি ডলারে নেমেছে, যা এক বছর আগে ছিল ৩ হাজার ৬১১ কোটি ডলার। আমদানি দায় মেটানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়মিত ডলার বিক্রি করার কারণে রিজার্ভ কমছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সামনে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। এ জন্য তিন-চার মাস সময় লেগে যেতে পারে। তখন ডলারের বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে এবং এর প্রভাব পড়বে বাজারে।

ব্যাংকগুলোর ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে বিদেশি ব্যাংকের নিশ্চয়তা লাগে। এখন ঋণপত্রে সবচেয়ে বেশি সহায়তা দিচ্ছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক।

আগে দুবাইভিত্তিক মাশরেক ব্যাংক ছিল শীর্ষে। কিন্তু ইসলামী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক ও জনতা ব্যাংক বড় অঙ্কের বিদেশি দায় পরিশোধে বিলম্ব করায় দুবাইয়ের ব্যাংকটি এই দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক এখন বিল-বন্ড জমা দেওয়া সাপেক্ষে কিছু ব্যাংককে ঋণপত্র খোলায় সহায়তা করছে। আগে চুক্তির ভিত্তিতে এই সেবা দিত।

এ নিয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখনো বেছে বেছে ঋণপত্র খুলছি। কত ডলার আসবে, এর ওপর ভিত্তি করে ঋণপত্র খোলা হচ্ছে। বিভিন্নভাবে ডলারের প্রবাহ বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। আশা করছি, সামনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে।’