প্রান্তিক চাষিদের এ বছর লাভ তো ও বছর ক্ষতি 

আলু চাষে কৃষকেরা এক বছর লাভ করেন তো আরেক বছর লোকসানে পড়েন। সে জন্য চাষিদের কেউ কেউ আর আলু চাষ না করার কথা ভাবছেন।

গোদাগাড়ীর ঈদলপুর গ্রামের আলুচাষি আওয়াল হোসেন
প্রথম আলো

আওয়াল হোসেন ২০ বছর ধরে আলু চাষ করছেন। ৭৫০ বস্তা (প্রতিটি ৬৫ কেজির) আলু হিমাগারে রেখেছিলেন। এর অর্ধেক ইতিমধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে। বাকি অর্ধেক বিক্রি হলে ২০২০ সালের প্রায় আট লাখ টাকার লোকসান উঠে আসবে। কিন্তু আগামী বছর তিনি আর আলু চাষ করবেন না। তাঁর বক্তব্য, এবার ভালো দাম পেলেও পরেরবার তা না–ও পেতে পারেন। কারণ, এই মৌসুমে বেশি দাম পেয়ে চাষিরা আগামীবার ব্যাপক হারে আলু চাষ করবেন এবং আবার পথে বসে যাবেন। কারণ, ২০ বছরে তিনি বুঝে ফেলেছেন যে দেশে চাহিদা আর জোগানে সমন্বয় করার কোনো উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ নেই।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ঈদলপুর গ্রামের আওয়াল হোসেন প্রথম আলোকে জানান, ২০২০ সালে তিনি এক হাজার মণ আলু হিমাগার থেকে বের করতে পারেননি। তাই হিমাগার কর্তৃপক্ষ সেই আলু নিলামে বিক্রি করে দিয়েছিল। এমন অবস্থার মুখে যেন আর পড়তে না হয়, সে জন্যই তিনি আলু চাষ না করে বাঁচতে চান।

আওয়াল হোসেন জানান, হিমাগারে আলু রাখার জন্য দুই রকমের বুকিং পদ্ধতি রয়েছে—‘লুজ বুকিং’ ও ‘পেইড বুকিং’। লুজ বুকিং হলো আলু বিক্রি করে হিমাগারমালিককে ভাড়া শোধ করতে হয়। এবারের লুজ বুকিংয়ের রেট হচ্ছে ৩৬৫ টাকা বস্তা। আর পেইড বুকিং হলো আলু রাখার সময়ই ভাড়ার টাকা শোধ করতে হয়। এবারের বুকিং রেট ২২৬ টাকা।

২০০১ সালে আওয়াল হোসেন তিন বিঘা জমিতে প্রথম আলু চাষ শুরু করেছিলেন। পরের বছর আরও জমি ইজারা নিয়ে ২০ বিঘা জমিতে আলু করেন। সেবার প্রায় সাত লাখ টাকা বিনিয়োগ করে মৌসুম শেষে লাভ হয়েছিল মাত্র ১০ হাজার টাকা। এরপর এক বছর ১০–২০ হাজার টাকা তো আরেক বছর ৫০ হাজার টাকা লাভ হয়। আবার কোনো কোনো বছর বড় লোকসানেও পড়তে হয়।

আওয়াল হোসেন জানান, ২০১৩ সালে ২২ বিঘায় উৎপাদিত ১ হাজার বস্তা আলু হিমাগারে রেখেছিলেন। প্রতি বস্তার ভাড়া ছিল ২৬৫ টাকা। সেবার চাহিদার অতিরিক্ত আলু উৎপাদিত হওয়ায় প্রতি বস্তার দাম ১০০–১৫০ টাকায় নেমে যায়। সে জন্য তিনি হিমাগার থেকে আলু তোলেননি। ফলে হিমাগার কর্তৃপক্ষ নিলামে সেই আলু বিক্রি করে দেয়। সেবার তাঁর মোট লোকসান হয় ৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা। পরের বছর সব ইজারা জমি ছেড়ে দিয়ে নিজস্ব ৫–৭ বিঘায় আলু চাষ করে ৪০ হাজার টাকার মতো লাভ হয়। ২০২০ সালে ৪০ বিঘা চাষ করে ৮ লাখ টাকা লোকসান দেন। 

একই রকমের কথা শোনান তানোরের চুনিয়াপাড়া গ্রামের চাষি আবু সাঈদ। তিনি জানান, আলুচাষিদের দুর্দশা দেখার মানুষ নেই। ২০২১ সালে তিনি ৯ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। খরচ মেটাতে ২৫০ মণ আলু ১১ টাকা কেজি দরে মাঠেই বিক্রি করতে হয়েছিল। বাকি ৬৫০ বস্তা হিমাগারে রেখেছিলেন। হিমাগারে ঠিকমতো হাওয়া না দেওয়ায় আলু নষ্ট হয়ে গেল। বাছাই করে ১২ টাকা কেজি দরে বাকি আলু বিক্রি করতে বাধ্য হন। লাভের আশায় গত বছর আট বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। আগেরবারের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে তোলার আগেই ১১ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করেন। কিন্তু বাজার পড়ে যাওয়ায় সাড়ে ১০ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করতে হয় আবু সাঈদকে। এবার তিনি এখনো হাত গুটিয়ে বসে আছেন, কী করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না।

চুনিয়াপাড়া গ্রামের আরেক আলুচাষি আতাউর রহমান জানান, হতাশায় আলু চাষ ছেড়েছেন দুই বছর হলো। সার, বীজ, ওষুধ—সবকিছুর দাম বেশি। আলু তোলার সময় দাম পাওয়া যায় না। হিমাগারে রাখলেও অর্ধেক নষ্ট হয়ে যায়। ফলে বাকি আলু বিক্রি করে হিমাগার ভাড়া দেওয়ার পর নিজের হাতে কিছু থাকে না।

আলুচাষিরা বলেন, অন্য ফসল চাষে লাভ থাকে বলেই তাঁরা আলুতে লোকসান হলেও বেঁচে যান। তাঁদের দাবি, যে বছর তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হন, সেবার সরকারি সংস্থা বিএডিসি বীজটা তো অন্তত সাশ্রয়ী দামে সরবরাহ করতে পারে। কিন্তু তারা তা করে না। আবার যে বছর উদ্বৃত্ত উৎপাদন হয়, সেবার যেন বাড়তি আলু রপ্তানির পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তাহলে কৃষকদের পথে বসতে হবে না। এ ব্যাপারে সরকারের নজরদারি থাকা জরুরি।