ব্যাংক ডুবিয়ে কোথায় গেলেন আবদুল হাই

শতভাগ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক একসময় ভালো ব্যাংক হিসেবেই পরিচিত ছিল। এ ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকতেন সাধারণত শিল্পসচিব। এই চর্চা প্রথমবারের মতো ভেঙে দেওয়া হয় ২০০৯ সালে। চেয়ারম্যান নিয়ে আসা হয় বেসরকারি খাত থেকে।

জাতীয় পার্টির আঞ্চলিক পর্যায়ের নেতা শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চুকে আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাংকটির চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়, যা কার্যকর হয় ২০০৯ সালের ৪ অক্টোবর থেকে। দুই দফায় পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ পান তিনি। এই পাঁচ বছরে ব্যাংকটিকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে নামিয়ে এনে ২০১৪ সালের ৫ জুলাই পদত্যাগ করেন তিনি। এ ব্যাংকের যাত্রা শুরু ১৯৮৯ সালে।

আবদুল হাই চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকেই ব্যাংকটির ঋণ বাড়তে থাকে। ব্যাংকিং নিয়মকানুন এড়িয়ে একক কর্তৃত্ববলে তিনি বড় আকারের ঋণ দেওয়া শুরু করেন। বুঝেশুনে ঋণ দেওয়া এ ব্যাংকের খেলাপি হার সব সময় থাকত ৫ শতাংশের নিচে। পাঁচ বছরে তিনি যেসব কীর্তি করে গেছেন, তার প্রভাবে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ওঠে ৬৮ শতাংশে। গত মাসে (মার্চে) এ হার দাঁড়ায় ৬৩ শতাংশ।

আবদুল হাই দেদার ঋণ দেওয়ার মধ্যেই আটকে ছিলেন না। কোনো ধরনের পরীক্ষা ছাড়া তিনি অবাধে জনবলও নিয়োগ দেন। ২০০৯ সালে ব্যাংকটির জনবল ছিল ৭৭৬ জন, ২০১৪ সালে এ সংখ্যা ২ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এখনো জনবল দুই হাজারের বেশি। জনবল বেশি হওয়ায় খোলা হয় বিভিন্ন অপরিকল্পিত শাখা।

বারবার আদালতের তিরস্কারের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সংসদ সদস্য ও বিশেষজ্ঞদের বিরূপ সমালোচনার পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত বছরের জুলাইয়ে শেখ আবদুল হাইকে আসামি করে মামলা দেয়। দুদকের ৫৮টি অভিযোগপত্রের প্রতিটিতেই তিনি আসামি। দুদকের অনুসন্ধানেই উঠে আসে, পাঁচ বছরে ব্যাংকটি থেকে ২ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার করা হয়। এই দুর্নীতির সহযোগী তাঁর ভাই শেখ শাহরিয়ার ওরফে পান্নাও। গত রাতে দুজনের সঙ্গেই মুঠোফোনে যোগাযোগ করে নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ ব্যাংক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় (সিএজি) এবং বেসিক ব্যাংকেরই প্রতিবেদনে এ কেলেঙ্কারির সঙ্গে শেখ আবদুল হাইয়ের জড়িত থাকার প্রমাণ উঠে আসে। কেলেঙ্কারির পর বেসিক ব্যাংক রক্ষায় বাজেট থেকে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা দেয় সরকার। তারপরও ব্যাংকটি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।

তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে ও সংসদের বাইরে বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎকে ডাকাতির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপস ২০১৯ সালে বলেছিলেন, এত বড় কেলেঙ্কারির পর তাঁকে গ্রেপ্তার না করা দুদকের ব্যর্থতা।

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, অধিকাংশ মামলা আমলে নিয়েছেন আদালত। শেখ আবদুল হাইয়ের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। আদালতের দৃষ্টিতে তিনি এখন পলাতক।

আবদুল হাই এখন কোথায় আছেন, বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ করেও তা জানা যায়নি। ব্যাংকটির সদ্য সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিসুর রহমান গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর (আবদুল হাই) কোনো খোঁজ তিনি জানেন না।

আরও পড়ুন

বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকার সময় শেখ আবদুল হাই ১১০ কোটি টাকা দিয়ে ঢাকায় দেড় বিঘার একটি বাড়ি কিনেছিলেন। একক কর্তৃত্বে নামে-বেনামে যে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিলেন, সেই ঋণের একটি বড় অংশ ঘুষ হিসেবে নিয়েছেন তিনি। সেই টাকা দিয়েই শেখ আবদুল হাই, তাঁর স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও ভাইয়ের নামে কেনা হয় এই বাড়ি। এ তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের।

শেখ আবদুল হাই ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকার সময় ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ১৩৮ কাঠা আয়তনের দুটি শিল্প প্লট কিনেছেন, যার বাজারদর ২০০ কোটি টাকার কাছাকাছি। তিনি যাতে এসব সম্পত্তি বিক্রি করতে না পারেন, সে ব্যাপারে আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

আরও পড়ুন

এ ছাড়া চেয়ারম্যান থাকার সময় পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ইডেন ফিশারিজের নামে ছয়টি এবং ভাই শেখ শাহরিয়ারের প্রতিষ্ঠান ক্রাউন ফিশারিজের নামে কেনা হয় দুটি জাহাজ। এসব জাহাজের বাজারদর প্রায় ১০০ কোটি টাকা। তবে এগুলো তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

আবদুল হাই বেসিক ব্যাংককে ধ্বংস করে গেছেন এবং এ কারণেই ব্যাংকটিকে এখন সিটি ব্যাংকের ঘাড়ে সরকার চাপিয়ে দিতে চাইছে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘শেখ আবদুল হাইয়ের এতগুলো অপরাধ সত্ত্বেও সরকার আগাগোড়াই এ নিয়ে বাজে ভূমিকা নিয়েছে। তাঁকে গ্রেপ্তার না করাটা রহস্যজনক ও দুঃখজনক।’