ফ্রিজের বাজার
সংকটেও ভালো বিক্রির আশা
ফ্রিজ উৎপাদন ও বাজারজাতের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা জানান, বছরে মোট ফ্রিজ বিক্রির ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ হয় দুই ঈদের মৌসুমে।
ডলার–সংকট, ঋণপত্র খোলা সীমিত হওয়া, বিশ্ববাজারে কাঁচামালের উচ্চমূল্য ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি—এই চার বড় সমস্যায় এক বছর ধরে চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের ইলেকট্রনিকস খাত। এর সঙ্গে মূল্যস্ফীতি গ্রাহকদের ওপর চাপ তৈরি করায় তারও প্রভাব পড়েছে এ খাতে। তবে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে বলে জানিয়েছে দেশের ইলেকট্রনিকস পণ্য প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো।
প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ার কারণে গত এপ্রিল থেকে এসি বিক্রি বেড়েছে। কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি পরিমাণে এসি বিক্রি করেছে তারা। আর এখন আসন্ন ঈদুল আজহা মৌসুমে ফ্রিজ বিক্রিও লক্ষ্যমাত্রা ছাড়াবে বলে প্রত্যাশা তাদের।
দেশের ফ্রিজের বাজার নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান বা গবেষণা নেই। তবে ২০২১ সালের মার্চে প্রকাশিত মার্কেটিং ওয়াচ বাংলাদেশের (এমডব্লিউবি) এক গবেষণায় বলা হয়, ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশের ফ্রিজের বাজার বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো নিয়ন্ত্রণ করত। সেই অবস্থা এখন বদলে গেছে। বিশেষ করে মানুষের আয় ও জীবনমান বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ফ্রিজের ব্যবহার বেড়েছে।
বর্তমানে বাজারে মোট বিক্রি হওয়া ফ্রিজের মধ্যে দেশীয় কোম্পানির হিস্যা ৮০ শতাংশের কাছাকাছি। বছরে গড়ে ১৫ শতাংশ হারে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই ইলেকট্রনিক পণ্যের বাজার বড় হচ্ছে। পাশাপাশি দেশীয় প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত ফ্রিজ রপ্তানিও হচ্ছে। অন্যদিকে একাধিক বিদেশি কোম্পানি স্থানীয়ভাবে ফ্রিজ ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনে এ দেশে বিনিয়োগ করছে।
বাজার কত বড়
একাধিক ফ্রিজ উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীরা জানান, বর্তমানে অভ্যন্তরীণ বাজারে ফ্রিজের চাহিদা আনুমানিক ৩০–৩২ লাখ। টাকার অঙ্কে তা প্রায় ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা। ২০১৮ সালে দেশে প্রায় ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ফ্রিজ বিক্রি হয়েছিল। তখন ফ্রিজের চাহিদা ছিল সাড়ে ২২ লাখের মতো। দেশে করোনা মহামারি শুরু হলে ২০২০ সালে ফ্রিজ বিক্রি কিছুটা কমে যায়। এরপর গত দুই বছরে আবার বিক্রি বেড়েছে।
দেশীয় কোম্পানির দাপট
একসময় ফ্রিজের বাজার পুরোটাই ছিল আমদানিনির্ভর। দেশে রেফ্রিজারেটর উৎপাদনের প্রথম উদ্যোগ নেয় দেশীয় প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন। এরপর একে একে যমুনা, মিনিস্টার, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, ট্রান্সকম ও ওরিয়ন কারখানা স্থাপন করে। বর্তমানে বিদেশি ব্র্যান্ড স্যামসাং, সিঙ্গার, ওয়ার্লপুল,
সনি–স্মার্ট ও কনকার কারখানা গড়ে উঠেছে দেশে।
ওয়ালটনের রেফ্রিজারেটর ইউনিটের প্রধান ব্যবসা কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, দেশে রেফ্রিজারেটরের চাহিদার সিংহভাগই ওয়ালটন পূরণ করছে। আমাদের হিসেবে দেশের ৭৫ শতাংশ মানুষের ঘরে ওয়ালটনের ফ্রিজ ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের ৪০টির বেশি দেশে ওয়ালটনের তৈরি ফ্রিজ রপ্তানি হচ্ছে।
ঈদেই বিক্রি দুই–তৃতীয়াংশ
ফ্রিজ উৎপাদন ও বাজারজাতের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা জানান, বছরে মোট ফ্রিজ বিক্রির ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ হয় দুই ঈদের মৌসুমে। আর অন্য সময়ে বিক্রি হয় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। প্রতিবছরই ঈদ মৌসুমে বিশেষ মূল্যছাড় ও অন্যান্য সুবিধা দিয়ে ক্রেতাদের টানার চেষ্টা করে কোম্পানিগুলো।
ট্রান্সকম ডিজিটালের ব্যবসাপ্রধান রিতেশ রঞ্জন জানান, চলতি বছরের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত অর্থাৎ গরমের সময়ে রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজারের চাহিদা বেশি থাকে। তবে ঈদুল আজহায় বেশি বিক্রি হয়।
দাম বেড়েছে ১৫–২০ শতাংশ
এক বছরের বেশি সময় ধরে চলমান ডলার–সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানির ঋণপত্র খুলতে পারেনি কোম্পানিগুলো। ফলে কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে বেড়েছে কাঁচামালের দাম ও পরিবহন খরচ। সব মিলিয়ে ফ্রিজ উৎপাদকদের উৎপাদন খরচ এক বছরে ৩০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
যমুনা গ্রুপের পরিচালক মনিকা নাজনীন ইসলাম বলেন, চলমান ডলার–সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করতে গিয়ে ঋণপত্র খুলতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কাঁচামাল আমদানি সহজ করতে সরকারি নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে সহযোগিতা প্রয়োজন।
উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেলেও সে তুলনায় দাম বৃদ্ধি করতে পারেনি বলে জানিয়েছে কোম্পানিগুলো। তারা জানায়, এক বছরে ফ্রিজের দাম ১৫–২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। তবে চলতি ঈদ মৌসুমে গ্রাহক ধরতে অনেকেই বিশেষ মূল্যছাড়সহ বিভিন্ন সুযোগ দিয়ে ফ্রিজ বিক্রি করছেন।
সুদহার বৃদ্ধিতে প্রভাব পড়তে পারে
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ব্যাংকঋণের সুদের হার বৃদ্ধি করেছে। এটি ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদন খাতে প্রভাব ফেলবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তবে বাজেটে দেশীয় কোম্পানির উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানোকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন ফ্রিজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
ইলেকট্রো মার্টের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নূরুল আফছার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক অঙ্কের সুদের হার এবং শুল্কসুবিধা ব্যবসা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। এখন সুদের হার পরিবর্তনের কারণে বিনিয়োগ প্রক্রিয়া কিছুটা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এ ছাড়া পণ্যমূল্য সমন্বয় করা হলে চাহিদাও কমতে পারে। তাতে আমাদের উৎপাদন প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হবে।’