কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা বদলে দিল যে ঘটনা

সীমিত আয়ের মানুষমাত্রই মূল্যস্ফীতির উত্তাপ টের পাচ্ছেন এখন। মূল্যস্ফীতির উত্তাপ সহনীয় রাখার ভার মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর। যদিও মুদ্রানীতির পাশাপাশি একটি সরকার এ জন্য রাজস্বনীতিকেও ব্যবহার করে। মূলত সরকার এর মাধ্যমে তার আয়-ব্যয়কে প্রভাবিত করে। করনীতিরও প্রয়োগ করা হয়। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতিই সবচেয়ে কার্যকর পন্থা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে ও বিচক্ষণতার সঙ্গে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করবে, এটাই সবাই আশা করেন। কিন্তু এর বদলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ যদি হয় সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ, তাহলে উল্টো অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্য গ্রেট ইনফ্লেশন’ তেমনই এক দৃষ্টান্ত। প্রায় দুই দশক স্থায়ী দ্য গ্রেট ইনফ্লেশনকে (১৯৬০-১৯৮০) যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক ব্যর্থতা বলেই অনেক মনে করেন।

তবে ব্যর্থতাই শেষ কথা নয়। আইনস্টাইন যেমনটা বলেছিলেন, ‘প্রতিটি সংকটের মধ্যেই রয়েছে দারুণ সুযোগ’। কার্যত এ ঘটনার মধ্য দিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগত রূপান্তর ঘটেছিল। জন্ম নিয়েছিল ফেডারেল রিজার্ভের স্বাধীন সত্তা। পরে এরই আদলে বিশ্বের অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও আধুনিকায়ন ঘটে। অর্থাৎ আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ কী হবে, তা ঠিক হয়েছিল দ্য গ্রেট ইনফ্লেশনের অবসানের মধ্য দিয়েই।

কী কারণে দ্য গ্রেট ইনফ্লেশন

গ্রেট ইনফ্লেশন কী কারণে ঘটেছিল, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তৎকালীন নীতিনির্ধারকেরা তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে মূল কারণ হিসেবে দেখিয়ে সরবরাহসংকটের ওপর নিজেদের দায় চাপাতে চেয়েছেন। কিন্তু অর্থনীতিবিদেরা আজ একমত যে সরকারের রাজস্বনীতি বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ব্যবহার করার কারণেই তখন মূল্যস্ফীতি দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল।

১৯৩০ সালে ঘটে যাওয়া বিশ্বমন্দার বেদনাদায়ক স্মৃতি, বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে ইউরোপের প্রস্থানের পর যুক্তরাষ্ট্রের উত্থান, এমন সব প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিপ্রণেতারা প্রবৃদ্ধি নিয়ে অতিসংবেদনশীল হয়ে উঠেছিলেন। এ অবস্থায় ১৯৫৬ সালের ‘এমপ্লয়মেন্ট অ্যাক্ট’ বাস্তবায়নে সরকার মরিয়া হয়ে ওঠে। পূর্ণ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করাই ছিল এ নীতির মূল লক্ষ্য। সরকারের লক্ষ্য অর্জনকে ত্বরান্বিত করতে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ঋণের সুদহার কম রেখে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বাড়িয়ে চলে।

যুক্তরাষ্ট্রের ৩৬তম রাষ্ট্রপতি লেনডন বি জনসন ভিয়েতনামের যুদ্ধ ও সামাজিক কার্যক্রমে বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে। এতে সরকার অর্থসংকটে পড়ে যায়। রিচার্ড নিক্সনের ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ১৯৭০ সালে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্ক ছাড়িয়ে যায়। এবার সবই সচকিত হয়ে ওঠে। কিন্তু তত দিনে দেরি হয়ে গেছে। বাজারে মুদ্রা সরবরাহ ঠিক রেখে মূল্যস্ফীতি কমাতে রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন বেশ কিছু উদ্যোগ নেন। তা সবই ব্যর্থ হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় আন্তর্জাতিক বাজারে তেল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা।

সে সময় নির্ভুল তথ্য-উপাত্তের অভাবও বড় ক্ষতির কারণ ছিল। তথ্যের ভুল ব্যাখ্যাও কম দায়ী ছিল না। ১৯৮০ সালে মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ আর বেকারত্ব বেড়ে হয় প্রায় ৮ শতাংশ। অর্থাৎ দেখা দেয় উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও উচ্চ বেকারত্ব। এই উভয়সংকটকে বলা হয় ‘স্ট্যাগফ্লেশন’। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে মূল্যস্ফীতি কমানো ছাড়া ফেডারেল রিজার্ভের হাতে আর কোনো উপায় ছিল না।

ফেডারেল রিজার্ভের পুনর্জন্ম

জীবনযাপনের অতিরিক্ত ব্যয় জনগণকে ক্ষুব্ধ করে তুলছিল। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ বা ফেডের কর্মকর্তারা আর অন্ধ হয়ে থাকতে পারলেন না। ১৯৭৯ সালে ফেডের নতুন চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন পল ভলকার। তিনি বাজারে অর্থ সরবরাহ কমানো ও প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়ার উদ্যোগ নিলেন। ঋণের সুদহার দফায় দফায় বাড়ানো হলো। এতে বাজারে ঋণপ্রবাহ কমে এল, বিনিয়োগ ও উৎপাদন কমল। বেকারত্বের হারও আরও বাড়ল। অর্থনীতি প্রবেশ করল একটি সংক্ষিপ্ত মন্দায়। তবে শেষ পর্যন্ত তাতে কাজ হয়েছিল। মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশে নেমে এলে মন্দা শেষ হয়। বেকারত্বও কমে যায়। যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশ করল অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির যুগে। শেষ হয় ‘গ্রেট ইনফ্লেশন’। রোনাল্ড রিগ্যান তখন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট।

সেই যে ফেড মুদ্রানীতি ব্যবহার করে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনল আজও সেই নীতি বজায় আছে। আজকের ফেডারেল রিজার্ভ বিশ্বাস করে যে ক্রয়ক্ষমতার স্থিতিশীলতার প্রতি দায়বদ্ধতাই হচ্ছে ভালো মুদ্রানীতির প্রথম শর্ত। আর মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা অবশ্যই নির্ধারণ করে দিয়ে মুদ্রানীতি পরিচালনা করতে হবে।

সমালোচনার মুখেও অটল

ফেডারেল রিজার্ভ এখনো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রধান লক্ষ্য মনে করে। ৪০ বছর ধরেই তারা মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশ হারে বজায় রাখার জন্য মুদ্রানীতি পরিচালনা করে আসছে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে প্রথমে কোভিড পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ায়। এতে বিশ্ববাজারে তেলের দর বাড়তে থাকে, সরবরাহব্যবস্থাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কারণে ঘটে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, যা গত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে অর্থ সরবরাহ কমাতে নীতিনির্ধারণী সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্তে অটল থাকে ফেড। গত ২৭ জুলাই চলতি বছরে চতুর্থবারের মতো সুদহার বাড়ানো হয়। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত সুদহার আড়াই শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চলতি বছরের শেষ নাগাদ সুদহার ৩ থেকে ৪ শতাংশে পৌঁছাতে পারে।

তবে ঋণের সুদহার বাড়ানোর ঘটনায় ফেড সমালোচনার মুখে পড়েছে। অনেক অর্থনীতিবিদই মনে করছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্রেট ইনফ্লেশনের দেখানো পথ অন্ধভাবে অনুসরণ করছে। কিন্তু অতীত সব সময় সেরা শিক্ষক নয়। কেননা এখন প্রযুক্তিনির্ভর আর্থিক খাত এখন অনেক দক্ষ, উৎপাদনব্যবস্থাও বৈচিত্র্যময়। সুতরাং বর্তমান সময়ের সমস্যা সমাধান নতুনভাবে করতে হবে।

এবারের মূল্যস্ফীতি মূলত সরবরাহজনিত সংকট থেকে এসেছে। এর সমাধান তুলনামূলকভাবে সময়সাপেক্ষ। যুক্তরাষ্ট্র এ লক্ষ্যে ‘ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট-২২’ নামে নতুন একটি আইনেরও অনুমোদন দিয়েছে, যার মধ্য দিয়ে জো বাইডেন প্রশাসন ৩০০ বিলিয়ন ডলারের রাজস্বঘাটতি কমানোর কথা রয়েছে। স্বাস্থ্যবিমায় সংস্কার এনেছে। তবে সরকার ৩৬৯ বিলিয়ন ডলারের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগটি করতে চলেছে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি খাতে। ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর সঙ্গে সবুজ প্রযুক্তিতে ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে।

নতুন আইন করলেও এখনো মনে করা হয় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকাই মূল। তবে হয়তো মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে ২ শতাংশ থেকে সরে আসতে হবে। ৩ বা ৪ শতাংশ পর্যন্ত লক্ষ্য নির্ধারণ করাটাই হবে বাস্তবসম্মত। শেষ পর্যন্ত বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বর্তমান সমস্যা থেকে কী শিক্ষা নেয়, সেটাই হবে এখন দেখার বিষয়।