রপ্তানিতে কেন পথ হারাল হোম টেক্সটাইল

চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এই খাতের রপ্তানি অর্ধেকে নেমেছে। ব্যবসায়ীরা জানান, তিন কারণে হোম টেক্সটাইলের রপ্তানি কমেছে।

দীর্ঘদিন ধরেই তৈরি পোশাকের পর চামড়া অথবা পাটপণ্যই ছিল দেশের শীর্ষস্থানীয় রপ্তানি খাত। করোনার পরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে এই দুটি খাতকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি খাত হিসেবে আবির্ভূত হয় হোম টেক্সটাইল। অবশ্য এক বছরের ব্যবধানেই বড় ধরনের হোঁচট খায় খাতটি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে হোম টেক্সটাইল পণ্যের রপ্তানি কমে গত অর্থবছরের একই সময়ের প্রায় অর্ধেকে নেমেছে।

একাধিক ব্যবসায়ী জানান, তিন কারণে হোম টেক্সটাইলের রপ্তানি কমেছে। প্রথমত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বজুড়ে হোম টেক্সটাইল পণ্যের চাহিদা কমেছে। দ্বিতীয়ত, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে গ্যাসের দাম ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধির পর উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। তৃতীয়ত, দেশে সুতার দাম আবারও বেড়েছে। মূলত শেষের দুই কারণেই প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমেছে।

হোম টেক্সটাইল পণ্যের মধ্যে রয়েছে বিছানার চাদর, বালিশের কভার, দরজা-জানালার পর্দা, কুশন ও বিভিন্ন ধরনের টেরিটাওয়েল। বর্তমানে বিশ্বের ১২৫টি দেশে বাংলাদেশের হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। তবে আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) হচ্ছে বড় বাজার। হোম টেক্সটাইল খাতে দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠান থাকলেও বর্তমানে রপ্তানি করছে ৫০-৬০টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নোমান গ্রুপ, হোম টেক্সটাইল লিমিটেড, সাদ মুসা, শাবাব ফেব্রিকস, অলটেক্স ইত্যাদি।

১৯৯০ সাল থেকে হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত শামসুদ্দিন টাওয়েল। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাইনুদ্দিন আহমেদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘হল্যান্ডের একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান দেড় দশক ধরে প্রতি মাসে আমাদের কাছ থেকে ৯ থেকে সাড়ে ৯ টন বিভিন্ন ধরনের টাওয়েল নিত। সম্প্রতি সেই পণ্যের জন্য তারা পাকিস্তানে ক্রয়াদেশ দিয়েছে। কারণ, সেখানে তারা প্রতি কেজিতে ৩০ সেন্ট কম দাম পেয়েছে। এ ছাড়া জার্মানির একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছ থেকে নিয়মিত একটি পণ্য নিচ্ছিল। তারা সেটি নেওয়া বন্ধ করেছে। মূলত গ্যাস-বিদ্যুৎ ও সুতার দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আমরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছি।’

উত্তর আমেরিকার হোটেলে ব্যবহৃত কম দামি টাওয়েলের ক্রয়াদেশ ভারত-পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে—এমন তথ্য দিয়ে মাইনুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রতি কেজি টাওয়েলের উৎপাদন ব্যয় আমাদের চেয়ে পাকিস্তানে ৩০ সেন্ট কম। বর্তমানে দেশি ও আমদানি করা সুতার দামের মধ্যে পার্থক্য ২৫-৩০ সেন্ট। ফলে বিদেশ থেকে সুতা আমদানির সুযোগ দিলেই আমরা হোম টেক্সটাইল রপ্তানিতে এগিয়ে যাব।’

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, করোনার আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮৫ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি হয়। পরের বছর করোনা মহামারির কারণে তা কমে ৭৬ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। তার পরের দুই বছর হোম টেক্সটাইলের রপ্তানি বেশ বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি ৪৯ শতাংশ বেড়ে ১১৩ কোটি ডলারে ওঠে। এর পরের অর্থবছরে তা আরও বেড়ে ১৬২ কোটি ডলার হয়। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৪৩ শতাংশ।

অবশ্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্বব্যাপী হোম টেক্সটাইলের চাহিদা কমে। এতে দেশের হোম টেক্সটাইল খাতের রপ্তানি ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে হোম টেক্সটাইলের রপ্তানি ৩২ শতাংশ কমে ১০৯ কোটি ডলারে নেমেছে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও অব্যাহত রয়েছে। অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক জুলাই-সেপ্টেম্বরে ১৮ কোটি ৯৫ লাখ ডলারের হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি হয়, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ কম।

বিশ্বে দুই বছর ধরে হোম টেক্সটাইল পণ্যের রপ্তানি কমছে। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী ১২২ দশমিক ৯০ বিলিয়ন বা ১২ হাজার ২৯০ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি হয়, যা পরের বছর কমে ৯১ বিলিয়নে নামে। গত বছর রপ্তানি হয় আরও কম, যা পরিমাণে ৮৫ বিলিয়ন ডলার।

ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের তথ্যানুযায়ী, চীন হোম টেক্সটাইলের শীর্ষ রপ্তানিকারক। গত বছর দেশটির হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি ১০ শতাংশ কমে ৩ হাজার ৭৬৬ কোটি ডলারে নেমেছে। ভারতের রপ্তানি ৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ কমে ৬০২ কোটি ডলার হয়েছে। পাকিস্তানের রপ্তানি অবশ্য ২ দশমিক ১৭ শতাংশ বেড়ে ৫৬৪ কোটি ডলারে উঠেছে।

বাংলাদেশ টেরি টাওয়েল অ্যান্ড লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিটিএলএমইএ) চেয়ারম্যান এম শাহাদাৎ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্যাসের দাম বাড়ানোর পর প্রতি কেজি টাওয়েলের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ৪৫ সেন্ট। সম্প্রতি সুতার দাম বেড়েছে ২৪ শতাংশ। এ জন্য ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে আমরা আর প্রতিযোগিতায় পারছি না।’

এম শাহাদাৎ হোসেন আরও বলেন, হোম টেক্সটাইল রপ্তানিতে যে ভালো সম্ভাবনা আছে, সেটির প্রমাণ এক বছর আগেও মিলেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যদি শুল্কমুক্ত সুবিধায় সুতা আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কিছুটা বাড়বে। সেটি হলে ডলার-সংকটের এই কঠিন সময়ে রপ্তানি আয় বাড়বে।