চিনির বাড়তি দামে উৎপাদন কমেছে মিষ্টি ও বিস্কুটের 

আটা, ময়দা ও সয়াবিনের পর এবার চিনির বাজার অস্থির। এতে চাপে পড়েছেন বেকারি পণ্য ও মিষ্টি প্রস্তুতকারকেরা। 

জ্বালানিসংকটের কারণে কিছুদিন থেকে কারখানা পুরোদমে চালাতে পারছিলেন না বেকারি পণ্য উৎপাদনকারী ও মিষ্টি প্রস্তুতকারকেরা। এর মধ্যে বাজারে দেখা দিয়েছে চিনির সংকট। সরকার নির্ধারিত ৯০ টাকা কেজি দরের খোলা চিনি বাজারে ১২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। সম্প্রতি আটা ও ময়দার দামও বেড়েছে কয়েক দফা। এতে উৎপাদন কমেছে মিষ্টি ও বিস্কুটের মতো পণ্যের। এখন ব্যবসা টেকাতে কাঁচামালের নিশ্চয়তা চান তাঁরা।

বেকারি ও মিষ্টি উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলমান জ্বালানিসংকটের মধ্যে চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে চিনির মতো মৌলিক কাঁচামালের সংকট। এতে অনেক প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। বাড়তি দামে উপকরণ কেনার ফলে লাভের অঙ্ক কমছে। দাম সমন্বয় করেও টিকতে হিমশিম খাচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে গ্যাসের চাপ কম থাকা ও বিদ্যুৎ–বিভ্রাটের ফলে অপচয় বেড়েছে। পণ্যের গুণগত মানও তা–ই ঠিক থাকছে না।

টিকে থাকতে মিষ্টি বিস্কুটের উৎপাদন কমিয়ে নোনতা বিস্কুট বেশি তৈরি করছে বেকারিগুলো। সময়ের সঙ্গে বাটারবান, কেক বা সাধারণ রুটির মতো পণ্যের উৎপাদনও কমে আসবে।
মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন, সভাপতি, বাংলাদেশ ব্রেড, বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতি

বনফুল অ্যান্ড কোম্পানি জানিয়েছে, চলমান জ্বালানি ও কাঁচামালসংকটের কারণে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন ৫০ শতাংশের মতো কমেছে। স্বাভাবিক সময়ে দেশব্যাপী পাঁচটি কারখানায় মিষ্টিজাতীয় পণ্যের দৈনিক উৎপাদন থাকে পাঁচ-ছয় টন, যা এখন দু-তিন টনে নেমে এসেছে। বেকারি পণ্যের উৎপাদনও প্রায় একই হারে কমেছে। উৎপাদন কমার কারণে তারা কর্মী ছাঁটাইও করছে।

শুধু বনফুল নয়, এ খাতের প্রায় সব প্রতিষ্ঠান এখন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কাঁচামালসংকটের কারণে ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠানকে বাধ্য হয়ে উৎপাদন কমাতে হচ্ছে। পরিস্থিতির দ্রুত উত্তরণ না হলে বেকারি পণ্য ও মিষ্টি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকতে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে বলে মনে করেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সার্বিক চাপের কারণে ইতিমধ্যে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন কমিয়েছে।

নতুন করে চিনির দাম বাড়ায় চাপে পড়েছে ছোট বেকারিগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ পণ্যে চিনি ব্যবহার করা হয়। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর চলতি বছরের জুন মাসের শুরুতে আটা, ময়দা ও সয়াবিনের দাম বৃদ্ধির ফলে এসব প্রতিষ্ঠান কেক, পাউরুটি ও বিস্কুটের মতো পণ্যের দাম সমন্বয় করে। এখন চিনির দাম বাড়লেও পণ্যের দাম সমন্বয়ের মতো পরিস্থিতি নেই। তাতে বেচাবিক্রিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে বলে জানিয়েছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা। সে জন্য বেকারি প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকার লড়াইয়ে চিনির ব্যবহার বেশি হয়, এমন পণ্যের উৎপাদন কমাচ্ছে।

এ বিষয়ে হস্তনির্মিত রুটি, বিস্কুট ও কেক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ব্রেড, বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিকে থাকতে মিষ্টি বিস্কুটের উৎপাদন কমিয়ে নোনতা বিস্কুট বেশি তৈরি করছে বেকারিগুলো। সময়ের সঙ্গে বাটারবান, কেক বা সাধারণ রুটির মতো পণ্যের উৎপাদনও কমে আসবে। তার আগে বেকারিগুলোর সুরক্ষার কথা ভেবে কাঁচামালপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা দিতে সরকারকে অনুরোধ জানাই।’

তবে মিষ্টি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা বেশি জটিল। জ্বালানির অনিশ্চয়তার কারণে উৎপাদন আগেই কমেছে। গ্যাসের অনিয়ন্ত্রিত প্রবাহের ফলে গুণগতমানের মিষ্টি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এখন চিনিসংকটের ফলে উৎপাদনই বন্ধ করতে হচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠানকে। বেকারিগুলো নোনতা বিস্কুট উৎপাদন করতে পারলেও মিষ্টি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য চিনি ছাড়া পণ্য উৎপাদন সম্ভব নয়। তাই এ খাতের ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মিষ্টি প্রস্তুতকারক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মারুফ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ মিষ্টির মতো পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে জ্বালানির তীব্র সংকট চলছে। চিনিসহ আটা-ময়দা ও সয়াবিনের দাম বাড়তি হওয়ায় আমাদের খরচ হু হু করে বাড়ছে, কিন্তু পণ্যের দাম সেভাবে বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে ভ্যাট-ট্যাক্সের জন্যও প্রতিনিয়ত চাপ দেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে ব্যবসা করার মতো পরিস্থিতি নেই। চরম সংকটে পড়েছে মিষ্টির ব্যবসা।’

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের তথ্য বলছে, গত এক বছরে দেশে খোলা আটার দাম বেড়েছে ৬৫ শতাংশ, খোলা ময়দার দাম বেড়েছে ৫১ শতাংশ। আর খোলা ও বোতলজাত সয়াবিনের দাম বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে। সেখানে চিনির বার্ষিক মূল্যবৃদ্ধির হার ৩৩ শতাংশের ওপর। বেকারি ও মিষ্টিজাতীয় পণ্য উৎপাদনের মূল উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হয় এসব কাঁচামাল।

দেশের বিস্কুটের বাজার কত বড়, তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। তবে একাধিক কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের মতে, বাজার প্রায় ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকার। তার মধ্যে ব্র্যান্ডের বিস্কুটের বাজার প্রায় অর্ধেক, ৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকার কাছাকাছি। প্রতিবছর ১২ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বিস্কুটের বাজার বড় হচ্ছে।