রাজধানীতে তারকা হোটেলের ব্যবসা এখন গুলশান ও উত্তরাকেন্দ্রিক। অর্থাৎ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের চেয়ে উত্তর সিটি করপোরেশনে অবস্থিত তারকা হোটেলগুলোর ব্যবসা ভালো। যেমন দক্ষিণের শাহবাগের ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের চেয়ে উত্তরের গুলশানের ওয়েস্টিন ও নিকুঞ্জের লা মেরিডিয়ানের আয় বেশি।
হোটেলগুলোর আয়ের বড় অংশ আসে খাবারদাবার বিক্রির মাধ্যমে। অর্থাৎ রুমভাড়া বাবদ হোটেলগুলো যে আয় করে, তার চেয়ে বেশি আয় হয় খাবার বিক্রির মাধ্যমে।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ঢাকার তিনটি তারকা হোটেল গত জুনে সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ৬৪১ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তরের ওয়েস্টিন ও লা মেরিডিয়ান হোটেলের ব্যবসা ছিল ৪৭২ কোটি টাকার। আর ঢাকা দক্ষিণের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যবসা করেছিল ১৬৯ কোটি টাকার। আবার হোটেলগুলোর রুম ভাড়ার চেয়ে খাবার বিক্রির আয় ছিল বেশি। যেমন গত অর্থবছরে রুম ভাড়া বাবদ তিন হোটেলের মোট আয় ছিল ২৯১ কোটি টাকা। এর বিপরীতে খাবার বিক্রিতে তাদের আয় হয়েছিল ৩০৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এসব তারকা হোটেল রুম ভাড়ার চেয়ে রেস্তোরাঁ ব্যবসা থেকে বেশি আয় করছে। হোটেলগুলোর গত অর্থবছরের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
বর্তমানে এই তিনটিসহ মোট পাঁচটি তারকা হোটেল দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। বাকি দুটি হলো কক্সবাজারের সি পার্ল বিচ রিসোর্ট ও চট্টগ্রামের দ্য পেনিনসুলা। এসব হোটেলের মধ্যে দুটি নিজস্ব ব্র্যান্ডের নামে, আর তিনটি মূল মালিকানা প্রতিষ্ঠানের নামে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সরকারি মালিকানা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সার্ভিসেস, লা মেরিডিয়ানের মালিকানা প্রতিষ্ঠান বেস্ট হোল্ডিংস, ওয়েস্টিনের মালিকানা প্রতিষ্ঠান ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস শেয়ারবাজারে রয়েছে। আর পেনিনসুলা ও সি পার্ল বিচ রিসোর্ট নিজস্ব ব্র্যান্ড নামেই তালিকাভুক্ত হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে পর্যটন খাতের কোম্পানি হিসেবে তালিকাভুক্ত। সর্বশেষ ৬ ফেব্রুয়ারি এ খাতে যুক্ত হয়েছে বেস্ট হোল্ডিংস। তাতে শেয়ারবাজারে পর্যটন খাতের কোম্পানির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫।
দক্ষিণের ব্যবসা এখন উত্তরে
রাজধানীর শাহবাগের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যবসা শুরু করে ১৯৭৩ সালে। এটি দেশের সবচেয়ে পুরোনো পাঁচ তারকা মানের হোটেল। একসময় রাজধানীর পাঁচ তারকা মানের হোটেল বলতেই মানুষ বুঝত ইন্টারকন্টিনেন্টাল। এরপর আশির দশকে এসে চালু হয় সোনারগাঁও হোটেল। ২০০০ সালের পর একে একে গুলশান ও বিমানবন্দর এলাকাকে ঘিরে বেসরকারি উদ্যোগে পাঁচ তারকা মানের হোটেল গড়ে উঠতে শুরু করে।
সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের সবচেয়ে পুরোনো পাঁচ তারকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ১৬৯ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। তার বিপরীতে ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত গুলশান-২ নম্বরের ওয়েস্টিন হোটেল ব্যবসা করেছে ২০৩ কোটি টাকার। আর ২০১৫ সালে ঢাকা বিমানবন্দরের কাছে নিকুঞ্জে চালু হওয়া লা মেরিডিয়ান হোটেল ব্যবসা করেছে ২৬৯ কোটি টাকার। এ তিন হোটেলের মধ্যে আবার রুম ভাড়াবাবদ সবচেয়ে বেশি আয় করেছে লা মেরিডিয়ান হোটেল। এ হোটেল রুম ভাড়াবাবদ ১৫০ কোটি টাকা আয় করেছে। একই সময়ে রুম ভাড়াবাবদ হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ৪৩ কোটি টাকা এবং ওয়েস্টিন ৯৮ কোটি টাকা আয় করে।
ঢাকার এ তিন হোটেলের মধ্যে খাবারের ব্যবসায় সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে অবশ্য ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল। হোটেলটি এক বছরে ১১২ কোটি টাকার খাবার বিক্রি করেছে। এরপর খাবার বিক্রিতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আয় ছিল লা মেরিডিয়ান হোটেলের। এ হোটেলে এক বছরে ১০০ কোটি টাকার খাবার বিক্রি হয়েছে। গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেল খাবার বাবদ এক বছরে আয় করে ৯৮ কোটি টাকা।
আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, তারকা মানের হোটেলের ব্যবসার বেশ কিছু খাত রয়েছে। তার মধ্যে বড় খাত হলো খাবার বিক্রি। এরপর রয়েছে দেশি-বিদেশি অতিথিদের কাছ থেকে রুম ভাড়াবাবদ পাওয়া অর্থ। এর বাইরে হোটেলগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য হল ভাড়া, হেলথ ক্লাব, স্পা, পারলার, সেলুন ও যানবাহন ভাড়া বাবদ আয় করে থাকে। তাদের এ ধরনের আয়ও নেহাত কম নয়। ঢাকার তিন হোটেলের মধ্যে এ খাত থেকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল এক বছরে আয় করেছে সর্বোচ্চ ১৪ কোটি টাকা। অন্যদিকে ওয়েস্টিন ১৩ কোটি টাকা ও লা মেরিডিয়ান ৯ কোটি টাকা আয় করে।
জানতে চাইলে ওয়েস্টিন হোটেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, হোটেল ব্যবসার ক্ষেত্রে অবস্থানগত দিকটি বড় বিবেচ্য বিষয়। ঢাকায় গুলশান ও বনানী কূটনৈতিক, ব্যবসায়ী ও ধনীদের এলাকা হিসেবে পরিচিত। এ কারণে গুলশানকেন্দ্রিক হোটেল ব্যবসা শাহবাগ বা কারওয়ান বাজারের তারকা হোটেলের চেয়ে বেশি।
খাবারের আয় বেশি কেন
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, হোটেলগুলোর রুম ভাড়ার চেয়ে খাবার বিক্রির আয় বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ একটি শ্রেণির মানুষের আয় বেশ বেড়েছে ও খাদ্যাভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। ঢাকার এই শ্রেণির মানুষের কাছে মাসে এক-দুবার পরিবার নিয়ে তারকা হোটেলে খাওয়াদাওয়া করা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তারকা হোটেলগুলোয় প্রশিক্ষিত শেফ দিয়ে তৈরি উন্নত মানের দেশি-বিদেশি খাবারের আয়োজন থাকে। এসব খাবারের স্বাদ নিতে তাই অনেকে ভিড় করেন।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান সন্তোষ কুমার দেব প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতির পাশাপাশি এখন মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব বেড়েছে। উন্নত দেশগুলোতে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পরিবার-পরিজন ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাওয়ার রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। আমাদের দেশেও একটি শ্রেণির মধ্যে সেটি দেখা যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে তারকা হোটেলের ব্যবসায়। এ ছাড়া করোনার সময় হোটেলগুলো খাবারের ব্যবসা বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিয়েছিল। সেটিও হোটেলগুলোর খাবারের ব্যবসাকে বড় করেছে।’
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে অবস্থিত তিনটি তারকা হোটেল গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬৪১ কোটি টাকা ব্যবসা করেছে।