বিদেশে আরও বাণিজ্যিক উইং হচ্ছে, তবে চালুগুলো নিয়েই সন্তুষ্ট নন ব্যবসায়ীরা

বিদেশে থাকা ৬১টি বাংলাদেশ মিশনে বর্তমানে ২৩টি বাণিজ্যিক উইং রয়েছে। সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে নতুন উইং খোলার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি তুলে ধরবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিদেশের মিশনগুলোতে আরও চারটি বাণিজ্যিক উইং খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের মিশনগুলোতে হবে একটি করে উইং। বাকি একটি হবে আফ্রিকা অঞ্চলে। আবার অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাওয়ায় বাতিল হতে পারে মিয়ানমার ও ইরানের বাণিজ্যিক উইং।
আফ্রিকা অঞ্চলে যে বাণিজ্যিক উইংটি হবে, সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি সেটি দক্ষিণ আফ্রিকায় হওয়ার।  

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আগামী সোমবার গণভবনে অনুষ্ঠেয় রপ্তানিসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির বৈঠকে নতুন বাণিজ্যিক উইং তৈরির গুরুত্ব তুলে ধরা হবে। এতে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ। বাণিজ্যসচিবের প্রবন্ধে বাণিজ্যিক উইং তৈরির কথা থাকবে বলে তিনি গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে জানান।

২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হলে বাংলাদেশকে কী ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে, তা নিয়ে করণীয় নির্ধারণে প্রধানমন্ত্রীকে সভাপতি করে ২০২২ সালের এপ্রিলে ‘রপ্তানিসংক্রান্ত জাতীয় কমিটি’ গঠন করা হয়। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশের কিছু বাণিজ্য সুবিধা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। বেশি সমস্যায় পড়তে হবে রপ্তানি খাতকে। এলডিসি হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আওতায় যে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা বাংলাদেশ পায়, তা আর পাওয়া যাবে না।

বিদেশে বর্তমানে ৬১টি মিশন রয়েছে বাংলাদেশের। আর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী মিশনগুলোর আওতায় বাণিজ্যিক উইং রয়েছে ২৩টি। তবে এমন দুটি করে উইং রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, বছর বছর বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের চেহারা বদলাচ্ছে। নতুন দেশ ও অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনাও বাড়ছে বাংলাদেশের। ফলে বেশ কয়েক বছর ধরে নতুন বাজারের দিকে ঢাকা মনোযোগও বাড়াচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে নতুন বাণিজ্যিক উইং তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

একই সঙ্গে কয়েকটি উইংয়ের স্থান পরিবর্তন হওয়ার ব্যাপারেও আলোচনা চলছে। যেমন সরকারের প্রাথমিক বিবেচনায় মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন ও ইরানের তেহরান উইং গুরুত্ব হারিয়েছে। ইয়াঙ্গুনের উইংটি সরিয়ে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে নিয়ে যাওয়া হতে পারে।

জানা গেছে, নতুন চারটি উইংয়ের জন্য স্থানের নাম অনেক আলোচনার পরই এসেছে। বিদেশে থাকা মিশনগুলোর রাষ্ট্রদূতেরা আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর অনুমোদনের জন্য তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ঘুরে তা যাবে এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগে। অর্থ বিভাগ অনুমোদন করলেই তা চূড়ান্ত হয়ে যাবে।

২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের পণ্য ও ৯০০ কোটি ডলারের সেবা রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পণ্য ও সেবা মিলিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানিতে আয় হয়েছে ছয় হাজার কোটি ডলারের কিছু বেশি। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল ৪ হাজার ৫০০ কোটি ডলার।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিলের তথ্য অনুযায়ী ১৫টি উইং রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। এগুলো হচ্ছে ক্যানবেরা, সিঙ্গাপুর, জেনেভা, দিল্লি, ব্রাসেলস, অটোয়া, বার্লিন, টোকিও, সিউল, ইয়াঙ্গুন, লন্ডন, ওয়াশিংটন, প্যারিস, দুবাই ও মাদ্রিদ। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি বেইজিং, কুয়ালালামপুর, মস্কো ও তেহরান। এ ছাড়া জেদ্দা, কুনমিং ও লস অ্যাঞ্জেলেস উইংও লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সাফল্য দেখাতে পারেনি বলে ইপিবির নজরে এসেছে।

বাণিজ্যিক উইংগুলোর কাজ মূল্যায়নে বাণিজ্যসচিবের নেতৃত্বাধীন কমিটি রয়েছে। উইংগুলো পরিচালিত হয় কমার্শিয়াল কাউন্সিলর বা কমার্শিয়াল কাউন্সিলরের দায়িত্বে থাকা প্রথম সচিবদের মাধ্যমে। অটোয়া, কলকাতা, কুনমিং, কুয়ালালামপুরে চারটিতে কাজ করছেন প্রথম সচিব (কমার্শিয়াল)। লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে আরও তৎপর থাকতে বছরে কয়েক দফায় চিঠি দেওয়া হয়। কাউকে অবশ্য কড়া কোনো বার্তা দেওয়া হয় না।

বাংলাদেশ নিট পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম অভিযোগ করেন, বেশির ভাগ বাণিজ্যিক উইংয়ের কর্মকর্তাদের খুব একটা তৎপর দেখা যায় না। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘উইংগুলোতে যে তাঁরা আছেন, সেটাই টের পাওয়া যায় না। দেশে দেশে অনৈতিক কার্যকলাপ হচ্ছে। ভুয়া তথ্য ও কাগজপত্র দিয়ে পণ্য নিয়ে পাওনা দিচ্ছে না, উইংগুলো এসব রোধে কোনো ভূমিকা রাখছে না।’

মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, ‘কমার্শিয়াল কাউন্সিলরদের মূল কাজ হচ্ছে বাংলাদেশি পণ্যের দূত হিসেবে কাজ করা এবং রপ্তানির গতি বাড়াতে সংশ্লিষ্ট দেশের নতুন নতুন আমদানিকারকদের সঙ্গে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। আমি বলব, তাঁরা তাঁদের মূল কাজ থেকে সরে থাকছেন।’

কেন হচ্ছে নতুন উইং

ইরানের তেহরান ও মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনকে বাতিল করার কারণ জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা জানান, তেহরান ২ কোটি ৭২ লাখ ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রাই অর্জন করতে পারেনি। আর ইয়াঙ্গুন ৩ কোটি ৪০ লাখ ডলারের রপ্তানি আয় অর্জন করতে পারেনি। এত কম লক্ষ্যমাত্রা দিয়েও যদি পূরণ না করা যায়, তাহলে উইংগুলো পোষার কোনো মানে হয় না।

সূত্রগুলো জানায়, পর্যটনকেন্দ্রিক দেশ হওয়ায় থাইল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযোগ বাড়ছে। আবার ইন্দোনেশিয়া একটি বড় দেশ এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশের পোশাক খাতের অন্যতম প্রতিযোগী। দেশটিতে পোশাকের বাইরের অন্য পণ্য, এমনকি সিগারেট রপ্তানিরও ভালো সম্ভাবনা আছে।

আর নতুন করে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে মেক্সিকোর সঙ্গে। বিশ্বের ১৫৬তম বৃহত্তম কোম্পানি হিসেবে পরিচিত মেক্সিকোর এক কোম্পানির নাম কোপেল। বিশ্বের ২ হাজার ৭০০টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের কাছ থেকে পণ্য কিনে থাকে এ কোম্পানি।

মেক্সিকোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম বাণিজ্যসচিবকে জানিয়েছেন, কোপেল বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকের পাশাপাশি বাইসাইকেল, হোম টেক্সটাইল, অন্তর্বাস, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, পাটজাত পণ্য এবং সিরামিক পণ্য আমদানি করতে আগ্রহী তারা। আর আফ্রিকার দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশি পণ্যের নতুন গন্তব্যস্থল।

ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান এ এইচ এম আহসানও আগামী সোমবারের বৈঠকে অংশ নেবেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, নতুন চার বাণিজ্যিক উইংয়ের ব্যাপারে অনেক দিন থেকেই আলোচনা হচ্ছে। এগুলো দরকার। তুর্কিয়েতে একটি উইং হওয়ার সিদ্ধান্তও হয়ে আছে। তবে ইরান ও মিয়ানমারের প্রয়োজনীয়তা প্রায় ফুরিয়েছে।

এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের রপ্তানির নতুন গন্তব্যস্থল খোঁজার সময় এখনই বলে মনে করেন ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান।