খাদ্যাভ্যাসে বদল, গম আমদানিতে রেকর্ড
গত বছর দেশে রেকর্ড পৌনে ৭৩ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে আমদানি বেড়েছে ৩৪ শতাংশ।
খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের কারণে দেশে গমের তৈরি খাবারের ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি গমের আমদানিও বাড়ছে। সদ্য বিদায়ী ২০২৪ সালে বিশ্ববাজারে গমের দাম নিম্নমুখী থাকায় আমদানিকারকেরা রেকর্ড পরিমাণ গম আমদানি করেছেন। যদিও রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আমদানি কিছুটা কমে গিয়েছিল। সেই খরা কাটিয়ে গত বছর রেকর্ড পরিমাণ গম আমদানি হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের হিসাবে, ২০২৪ সালে প্রায় ৭২ লাখ ৭৫ হাজার টন গম আমদানি হয়েছে। ২০২৩ সালে আমদানি হয়েছিল ৫৪ লাখ ১৭ হাজার টন। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে গম আমদানি বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। আমদানি বৃদ্ধির এই হার গত আট বছরে সর্বোচ্চ।
সরকারি–বেসরকারি দুই খাতে গম আমদানি হয়। ২০২৪ সালে সরকারি খাতে গম আমদানি ২০২৩ সালের তুলনায় ৯২ শতাংশ বেড়ে প্রায়
নয় লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। বেসরকারি খাতে প্রায় ২৯ শতাংশ বেড়ে ৬৩ লাখ ৭৭ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর আমদানি হওয়া গমের অর্ধেকই এসেছে রাশিয়া থেকে। দেশটি থেকে আমদানি হয় ৩৬ লাখ ৫৯ হাজার টন গম, যা মোট আমদানির প্রায় ৫০ শতাংশ।
দেশে গমের চাহিদার ১৪–১৫ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়। আর চাহিদার বাকি ৮৫ শতাংশই আমদানি হয়। গত বছর উৎপাদন ও আমদানি মিলে গমের সরবরাহ ছিল ৮৪ লাখ ৪৭ হাজার টন, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।
জানতে চাইলে টি কে গ্রুপের পরিচালক মোস্তফা হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, মানুষ এখন আগের তুলনায় গমের খাদ্যপণ্য বেশি খাচ্ছে। গমের তৈরি খাদ্যপণ্যের রপ্তানিও বাড়ছে। চাহিদার কারণে গত বছর রেকর্ড পরিমাণ গম আমদানি হয়েছে।
মানুষ এখন আগের তুলনায় গমের খাদ্যপণ্য বেশি খাচ্ছেন। গমের তৈরি খাদ্যপণ্যের রপ্তানিও বাড়ছে। এ কারণে গত বছর রেকর্ড পরিমাণ গম আমদানি হয়েছে।
গমের খাবারে ঝুঁকছেন ধনী–গরিবেরা
স্বাস্থ্যসচেতনতার কারণে মানুষ অনেক দিন ধরে ভাত কমিয়ে গমের খাবারের প্রতি ঝুঁকেছেন। এক বেলা ভাত ও দুই বেলা রুটি খাওয়া মানুষের সংখ্যা এখন অনেক বেশি। ধনীদের খাবারের তালিকায় রুটি খাওয়া এখন পরিচিত দৃশ্য।
আবার দেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যাও প্রতিবছর আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে, যাঁরা এক বেলা ভাতের পরিবর্তে রুটি খান। ২০২৩ সালে প্রকাশিত ডায়াবেটিস চিকিৎসার জাতীয় নির্দেশিকায় বলা হয়েছিল, দেশে প্রায় ১ কোটি ৩১ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছেন।
দামের কারণে এখন গরিব মানুষও আটার রুটিতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, বাজারে এখন মোটা চালের কেজি ৫০–৫৫ টাকা। আর খোলা আটার দাম প্রতি কেজি ৪০–৪৫ টাকা; অর্থাৎ চালের চেয়ে গমের দাম কেজিতে ১০ টাকা কম।
ভাত কমিয়ে গমের ব্যবহার বাড়ার বিষয়টি উঠে এসেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসের খানা আয়–ব্যয় জরিপেও। ২০২৩ সালে প্রকাশিত সংস্থাটির জরিপ অনুযায়ী, ২০১৬ সালে একজন মানুষ দিনে গড়ে ১৯ দশমিক ৮০ গ্রাম গমের খাবার গ্রহণ করতেন। ২০২২ সালে তা বেড়ে ২২ দশমিক ৯০ গ্রামে উন্নীত হয়; অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানে গমের খাবারের ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ।
গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষ গমের খাদ্যপণ্য বেশি খান। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, ছয় বছরের ব্যবধানে গ্রামের চেয়ে শহরে গমের খাবারের ব্যবহার বেড়েছে ২৬ শতাংশ। এর বিপরীতে চালের ভোগ ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ কমেছে।
খাদ্যপণ্য সবই গমের
এক দশক আগে হাতেগোনা কয়েকটি শিল্প গ্রুপ খাদ্যপণ্য বাজারজাত করত। চাহিদা বৃদ্ধিতে এখন বড় বড় শিল্প গ্রুপও খাদ্যপণ্যের ব্যবসায় নজর দিয়েছে। এসব শিল্প গ্রুপ খাদ্যপণ্য তৈরির জন্য প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ গম আমদানি করে। উদাহরণ হিসেবে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের কথাই ধরা যাক। গ্রুপটির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, খাদ্যপণ্য তৈরিতে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বছরে দেড় লাখ টনের বেশি আটা দরকার হয়। এই খাদ্যপণ্য দেশে বাজারজাত হচ্ছে। আবার বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।
বর্তমানে নুডলস, বিস্কুট, পাউরুটি, চানাচুরসহ শুকনা খাবার এবং হিমায়িত খাদ্যপণ্য তৈরি হচ্ছে গম দিয়ে।
জানতে চাইলে প্রাণ–আরএফএল গ্রুপের বিপনণ পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, দেশে খাদ্যপণ্যের বাজার দিন দিন বড় হচ্ছে। রপ্তানিও হচ্ছে। খাদ্যপণ্য তৈরির শিল্প খাতে বিপুল পরিমাণ গমের চাহিদা রয়েছে, যা নিয়মিত বাড়ছে। শুধু প্রাণ–আরএফএল গ্রুপের খাদ্যপণ্য তৈরির জন্য বছরে দেড় লাখ টনের বেশি গমের দরকার হয়।
এনবিআরের হিসাবে, বিশ্বের ৯৩টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশে তৈরি খাদ্যপণ্য। তাতে বছরে রপ্তানি আয় হচ্ছে কম–বেশি ২০ কোটি মার্কিন ডলার। চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে শুকনা খাবার রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১১ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ শতাংশ বেশি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গমের তৈরি খাদ্যপণ্যের বিশাল শিল্প গড়ে উঠেছে দেশে। তাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ছে। দেশীয় ভোগের পাশাপাশি গমের তৈরি খাদ্যপণ্য রপ্তানিও হচ্ছে। গম আমদানি বাড়লে খাদ্যপণ্য তৈরির বড় কারখানা, বেকারি, কনফেকশনারি ও হোটেল–রেস্তোরাঁয় কর্মব্যস্ততা বাড়ে। আবার গমের উপজাত ভুসি প্রাণী ও পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে প্রাণী ও পশুখাদ্য হিসেবে সাধারণ আমিষযুক্ত গমেরও ব্যবহার হচ্ছে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গম আমদানি বাড়ার বিষয়টি ইতিবাচক। সরকার গত বছর খাদ্য নিরাপত্তার জন্য গম আমদানি বাড়িয়েছে। আবার বেসরকারি খাতেও গমের ব্যবহার বেড়েছে। গমের তৈরি পণ্যে মূল্য সংযোজন হচ্ছে।