মুদ্রার স্বর্ণমান কি আবার ফিরে আসছে

এটা বিশ্বাস করা হয়তো কঠিন, কিন্তু মনে হচ্ছে বিশ্ব স্বর্ণমানভিত্তিক সেই পুরোনো মুদ্রাব্যবস্থায় আবার ফিরে যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাতের কর্তাব্যক্তিরা এটা পছন্দ করুন আর নাই করুন, বিশ্ব সে পথে হাঁটছে বলেই ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। একসময় দেশে দেশে মুদ্রার মান নির্ধারিত হতো সোনার ওপর ভিত্তি করেই।

ফোর্বসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বর্ণমান নিয়ে অনেক রকম ভুল ধারণা আছে। আর এসব ভুল ধারণার ভিত্তিতে অনেক গল্পকথাও প্রচলিত রয়েছে। তবে এই ব্যবস্থা কাজ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ১৮০ বছর ধরে স্বর্ণমান ব্যবহার করেছে। দেশটি এই ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছে ১৯৭০-এর দশকে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র যত দিন ডলারের মূল্য নির্ধারণে স্বর্ণমান ব্যবহার করেছে, তত দিন দেশটিতে মূল্যস্ফীতি ছিল না। আর এই সময়েই মানব ইতিহাসের সবচেয়ে লম্বা সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।

কিন্তু ডলারকে যখনই স্বর্ণমান থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক গড় প্রবৃদ্ধি এক-তৃতীয়াংশ কমে যায়। সেই ১৮০ বছর ধরে দেশটির অর্থনীতি যেভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে, তা যদি এখনো বজায় থাকত, তাহলে আজ খানাপ্রতি গড় আয় কমপক্ষে ৪০ হাজার ডলারের বেশি হতো।

স্বর্ণভিত্তিক মুদ্রাব্যবস্থার প্রতি বিদ্বেষ অবশ্য এখন বিশ্বব্যাপী। তবে একসময় যা ভাবাও যেত না, তেমন ঘটনাও ঘটতে পারে। একসময় তা বাস্তব হয়েও দাঁড়ায়। সেসব ইঙ্গিত এখন পরিষ্কার।

একটি ইঙ্গিত হলো, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কয়েক বছর ধরে রেকর্ড মাত্রায় সোনা কিনছে। এই ক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে চীন, ভারত, রাশিয়া ও পোল্যান্ডের মতো দেশ। ডলারের দীর্ঘমেয়াদি মূল্য সম্পর্কে এসব দেশ আরও জোরালোভাবে তাদের সন্দেহ জানান দিচ্ছে। তাদের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমছে।

আরেকটি ইঙ্গিত হলো, ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ক্রিপ্টো মুদ্রার জনপ্রিয়তা। তবে সমস্যা হলো, বেশির ভাগ ক্রিপ্টোকারেন্সির উদ্ভাবকেরা, যার মধ্যে রয়েছে বিটকয়েনও—এটা বুঝতে চান না যে একটি মুদ্রাকে স্থিতিশীল হতে হয়। বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিসহ বাণিজ্যিক লেনদেনে এই মুদ্রা ব্যবহার করতে হলে।

মাত্র কয়েকটি ক্রিপ্টোকারেন্সি সোনার সঙ্গে সংযুক্ত আছে। কিন্তু ব্যাপকভাবে ব্যবহারের জন্য এগুলো এখনো বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করা কিংবা প্রয়োজনীয় কাঠামো তৈরি করতে পারেনি। তবে বিভিন্ন দেশের সরকার যখন তাদের মুদ্রানীতি ঘষামাজা করবে, তখন তার পরিবর্তন হবে।

যেভাবে ঋণ বাড়ছে, তা সংকট তৈরি করবে। এটাকে সহজে প্রশমিত করা যাবে না। পুরো বিশ্বে ঋণের পরিমাণ এখন ৩০০ ট্রিলিয়ন (তিন কোটি কোটি) ডলার। এটি বৈশ্বিক জিডিপির তিন গুণ।

আর অবশ্যই নজর রাখতে হবে ব্রিকসের কর্মকাণ্ডের দিকে। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন নিয়ে এই জোট গঠিত হলেও পরে এতে যোগ দেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। এই জোটে ইতিমধ্যেই যোগ দিয়েছে আরও কয়েকটি দেশ। বিশ্বের বৃহত্তম অপরিশোধিত তেল উৎপাদনকারী দেশ সৌদি আরবও জোটে যোগ দিতে আগ্রহী। এসব দেশের মুদ্রাব্যবস্থা এখনো খুব বড় নয়। কিন্তু এখানেও পরিবর্তন আসছে।

ভারত গত বছরে স্বর্ণভিক্তিক সরকারি বন্ড নিয়ে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে। ‘ইনফ্লেশন: হোয়াট ইট ইজ, হোয়াই ইটস ব্যাড অ্যান্ড হাউ টু ফিক্স ইট’ বইয়ের সহলেখক নেথান লুইস বলেন, ‘এটা সম্ভবত বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের কাছে জনপ্রিয় হবে। মুদ্রা ভাসমান করা থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত দেখলে, ৪ শতাংশ সুদ দিচ্ছে, এমন একটি স্বর্ণবন্ড বিশ্বের যেকোনো জায়গায় সব শেয়ার ও বন্ডের চেয়ে ভালো করবে।’

সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতির রেকর্ড গড়েছে জিম্বাবুয়ে। দেশটি সম্প্রতি ঘোষণা করেছে যে তারা একটি নতুন মুদ্রা বাজারে ছাড়বে, যেটি সোনার সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। এই ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় শৃঙ্খলা দেশটির সরকারের আছে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। কিন্তু এই পদক্ষেপ এমন ইঙ্গিত দিচ্ছে যে পরিবর্তন আসছে।