প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে আমের রপ্তানি, নতুন বাজার ১০ দেশ

চাঁপাইনবাবগঞ্জের রোহনপুরে রফিকুল ইসলামের আম বাগান।
ছবি: রফিকুল ইসলামের সৌজন্যে

চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষি উদ্যোক্তা রফিকুল ইসলাম এবার ১৪ টন আম বিদেশে পাঠিয়েছেন। গত বছর তিনি আম রপ্তানি করেননি, আগের দুই বছর করেছিলেন। তবে এবারের মতো এত পরিমাণ রপ্তানি আগে কখনোই হয়নি। এ বছর রপ্তানি করা আমের জাতের মধ্যে ছিল হাঁড়িভাঙা, গৌড়মতি, আম্রপালি ও বারি-৪।  আগামী বছর আরও বেশি পরিমাণ আম রপ্তানির আশা করেন জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার রোহনপুরের এই উদ্যোক্তা।

বিদেশে আম রপ্তানিতে আগ্রহের একাধিক কারণ আছে বলে জানালেন রফিকুল। প্রথম আলোকে তিনি বলছিলেন, ভরা মৌসুমে আমের ফলন হয় প্রচুর, কিন্তু ক্রেতা থাকেন কম। অন্তত ২০ ভাগ আম খামারির বাগানেই নষ্ট হয়। তখন সেই আম রপ্তানির কাজে লাগানো গেলে ভালো। আবার বিদেশে আম রপ্তানিতে আর্থিক লাভও বেশি।

আম হয়তো নষ্টই হয়ে যেত, সেটা কাজে লাগানো যাচ্ছে। আবার ভালো পয়সাও মিলছে, বলেন রফিকুল ইসলাম। দুটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এবার আম বিদেশে পাঠিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে একটি হলো এমবিবি অ্যাগ্রো লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. বদরুদ্দোজা সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে থাকেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে তাঁর গ্রামের বাড়ি। আজ ৩২ বছর ধরে সুইডেনে আছেন আর দেশ থেকে আম রপ্তানি করছেন ২০১২ সাল থেকে। গত বছর তিনি দেশ থেকে ৩০ টন আম নিয়েছিলেন, এবারে তার পরিমাণ ৬০ টনের কাছাকাছি।

মো. বদরুদ্দোজা বলেন, ‘সুইডেনে বাংলাদেশের আমের চাহিদা বাড়ছে। এটা যেমন প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে বেড়েছে, তেমনি স্থানীয় সুইডিশদের মধ্যেও বেড়েছে। যিনি একবার বাংলাদেশের আম খেয়েছেন, তিনি আর ছাড়বেন না।’

বিদেশে বাংলাদেশের আমের বাড়তে থাকা চাহিদার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে রপ্তানিতে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের ২১ আগস্ট পর্যন্ত ৩ হাজার ৪৫ মেট্রিক টনের বেশি আম রপ্তানি হয়েছে। অথচ গত বছর পুরো সময়টায় আম রপ্তানি হয়েছিল ১ হাজার ৭৫৭ মেট্রিক টন।

‘চলতি বছর আম রপ্তানি আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এবারে রপ্তানি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। আগামী বছর আমরা সাড়ে চার হাজার মেট্রিক টন রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। রপ্তানিকারকদের যে প্রবণতা দেখছি, তাতে এটা সম্ভব বলে মনে হয়।’
মোহাম্মদ আরিফুর রহমান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘চলতি বছর আম রপ্তানি আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এবারে রপ্তানি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। আগামী বছর আমরা সাড়ে চার হাজার মেট্রিক টন রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। রপ্তানিকারকদের যে প্রবণতা দেখছি, তাতে এটা সম্ভব বলে মনে হয়।’

আম গেছে নতুন ১০ দেশে, বাড়ছে রপ্তানিকারক

গত বছরের মতো এবারও বাংলাদেশের আম সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাজ্যে। ইউরোপের এ দেশে এ বছর প্রায় ১ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন আম রপ্তানি হয়েছে। গত বছর এর পরিমাণ ছিল এর অর্ধেকের কম। এবার রপ্তানির তালিকায় নতুন ১০টি দেশ যুক্ত হয়েছে। বিশ্বের অন্যতম প্রধান আম রপ্তানিকারক দেশ ভারতেও এবার বাংলাদেশের আম রপ্তানি হয়েছে।

নতুন রপ্তানি গন্তব্যের পাশাপাশি আম রপ্তানিকারকের সংখ্যাও বেড়েছে।  গত বছর কাগজে-কলমে ৬০টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান থাকলেও এর মধ্যে ৫০টির বেশি প্রতিষ্ঠান আম রপ্তানি করেনি বলে জানান মোহাম্মদ আরিফুর রহমান। তিনি বলেন, এ বছর ৭০-এর বেশি রপ্তানিকারক আম রপ্তানি করেছেন। ভবিষ্যতে এই সংখ্যা আরও বাড়বে। কারণ, রপ্তানিতে ভালো মুনাফা দেখছেন রপ্তানিকারকেরা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষি উদ্যোক্তা মো. রফিকুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

প্রবাসীদের পাশাপাশি বিদেশি ভোক্তা

দেশের আম রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের অন্যতম গ্লোবাল ট্রেড লিংক। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান রাজিয়া সুলতানা এ বছর ৫৬ মেট্রিক টন আম রপ্তানি করেছেন। তাঁর রপ্তানি করা আমের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল আম্রপালি। এর পাশাপাশি হাঁড়িভাঙা, বারি-৪ আমও বিদেশে পাঠিয়েছেন।

রাজিয়া সুলতানা বললেন, ‘আমাদের রপ্তানি করা আমের প্রধান ভোক্তা ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। কিন্তু এবার আমার রপ্তানি করা আম সুইজারল্যান্ডের মূল বাজারে গেছে। চলতি বছরে প্রথমবারের মতো আমি পর্তুগালেও আম রপ্তানি করেছি। প্রবাসী অধ্যুষিত দেশের পাশাপাশি যেসব দেশে আমের চাহিদা আছে, সেখানকার বাজারে বাংলাদেশের আম ঢুকছে।’

সুইডেনপ্রবাসী ব্যবসায়ী মো. বদরুদ্দোজাও জানাচ্ছেন যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বাজার বড়, তবে সুইডেনের স্থানীয় বাজারেও বাংলাদেশের আম যাওয়া শুরু হয়েছে। ‘এটা শুভ দিক। আর আমাদের আম যেভাবে তাঁরা গ্রহণ করেছেন, সেটাও আশাব্যঞ্জক।’

প্যাকেজিং, উড়োজাহাজের ভাড়া

আম রপ্তানিকারকেরা যুক্ত আছেন বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবলস অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্ট এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে। সংগঠনটির উপদেষ্টা মো. মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘আম রপ্তানিতে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু রপ্তানি বৃদ্ধির গতি টেকসই করতে সরকারিভাবে যে উদ্যোগ দরকার, তা ততটা দেখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় নেই। এসব সমস্যায় আমাদের প্রতিনিয়ত পড়তে হয়।’

বাংলাদেশের অনেক রপ্তানিকারকের আম বিদেশে গিয়ে আবার ফেরত আসে মূলত উন্নত প্যাকেজিংয়ের অভাবে আম নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে। এ বিষয়ে এমবিবি অ্যাগ্রোর প্রধান মো. বদরুদ্দোজা নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানান। তিনি ২০১২ সালে যখন প্রথম আম রপ্তানি শুরু করলেন, তখন নিজের হাতে প্যাকেট তৈরি করে তা করেছিলেন। তাতে কোনো আম বাংলাদেশে ফেরত নিয়ে আসতে হয়নি।

‘এরপর সুইডেন থেকে দেশে যতবার গেছি, ভারত বা পাকিস্তানের উন্নত মানের প্যাকেট নিয়ে গেছি। রপ্তানির জন্য অপরিহার্য একটা প্যাকেজিং শিল্প আমাদের হলো না, এটা দুর্ভাগ্য,’ খানিকটা ক্ষোভ শোনা গেল তাঁর কণ্ঠে।

এমবিবি এগ্রোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. বদরুদ্দোজা
ছবি: সংগৃহীত

আম রপ্তানিকারকদের কাছে উড়োজাহাজের ভাড়া একটা বড় সমস্যা। আমের প্যাকেজিং, অভ্যন্তরীণ যাতায়াত ব্যয়, শ্রমিকের খরচ—এসবের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের খুব কমবেশি নেই। কিন্তু উড়োজাহাজের ভাড়া অনেকটা বেশি।

আর তাতে বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের আম পিছিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন গ্লোবাল ট্রেডের রাজিয়া সুলতানা। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে তিনি যেসব দেশে আম পাঠিয়েছেন, তাতে প্রতি কেজি আমের উড়োজাহাজের ভাড়া পড়েছে ২২০ থেকে ২৫০ টাকা। ওই একই গন্তব্যে ভারতীয় রপ্তানিকারকদের খরচ পড়েছে ১৫০ রুপির মতো।  

উড়োজাহাজের ভাড়া অপেক্ষাকৃত যে বেশি, তা মানেন রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান। তিনি জানালেন, উড়োজাহাজের ভাড়া কমানো, প্যাকেজিংসহ অন্য উপকরণগুলো উন্নত ও সহজলভ্য করার জন্য তাঁরা চেষ্টা করছেন।

আম রপ্তানিকারকদের কাছে উড়োজাহাজের ভাড়া একটা বড় সমস্যা। আমের প্যাকেজিং, অভ্যন্তরীণ যাতায়াত ব্যয়, শ্রমিকের খরচ—এসবের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের খুব কমবেশি নেই। কিন্তু উড়োজাহাজের ভাড়া অনেকটা বেশি।

আর তাতে বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের আম পিছিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন গ্লোবাল ট্রেডের রাজিয়া সুলতানা। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে তিনি যেসব দেশে আম পাঠিয়েছেন, তাতে প্রতি কেজি আমের উড়োজাহাজের ভাড়া পড়েছে ২২০ থেকে ২৫০ টাকা। ওই একই গন্তব্যে ভারতীয় রপ্তানিকারকদের খরচ পড়েছে ১৫০ রুপির মতো।  

উড়োজাহাজের ভাড়া অপেক্ষাকৃত যে বেশি, তা মানেন রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান। তিনি জানালেন, উড়োজাহাজের ভাড়া কমানো, প্যাকেজিংসহ অন্য উপকরণগুলো উন্নত ও সহজলভ্য করার জন্য তাঁরা চেষ্টা করছেন।